খই নাড়ু, পদ্মপাতা, মশারি 

তড়িৎ রায় চৌধুরী 

চোর নয় গো; চার। গ্রামের নাম চারকলগ্রাম। ঘটের পটের মিলিয়ে প্রায় ৩৩ টা ঠাকুর হত—হু। সে আমার ছোটবেলার গল্প। মানে গত শতাব্দীর আশির দশক।

বাবারা পাঁচ ভাই তিন বোন। মা দুর্গার মতোই ছানা পোনা সমেত সবাই হাজির হতেন গ্রামের বাড়িতে। হই হই কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার। ততদিনে গ্রামের বাড়িও খই নাড়ু বানিয়ে, পদ্মপাতা, মশারি জোগাড় করে তৈরি। নাড়ুরা তো বাবাদের মতোই অনেক ভাই; খই তিল সিঁড়ি নারকেল। তবে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক আর সিঁড়ির নাড়ু দুটোই ভারি শক্ত। মাটির দোতলায় ওঠার সিঁড়ি তত শক্ত না। 

নতুন জামার গন্ধ, এতগুলো তুতো-তুতি ভাই-বোনের সঙ্গ একেবারে গরম করে রাখত। উষ্ণ গ্যাসের মতো ক্ষুদে বাহিনীর তীব্র ছোটাছুটিতে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোর চলকা উঠে যেত। ঠাকুমা বলতেন, এবার বাড়িটাই ভেঙে পড়বে। হিরণ পিসি মানে যিনি বাড়িতে ন্যাতা-পোছা করতে আসতেন পরদিন যত্ন করে গোবর দিয়ে সিঁড়ির শুশ্রূষা করতেন। এখন মনে হয় মাটির বাড়ির গোবর নেকানোর গল্প হয়তো রোজকার ক্ষয়পূরণ।

সপ্তমীতে বাড়ি পৌঁছেই কাঁসরটা নিয়ে দুই ভাই চলে যেতাম ঠাকুরতলা, আরতির ডাকে। পাড়ায় নানা বাড়ির ছেলেরা আসত কাঁসর ঘন্টা নিয়ে। একটা নির্দিষ্ট ছন্দে বাজাতো সবাই। কানে তালা ধরে যেত। তবু ছাড়তে পারতাম না। এভাবেই দেবী বন্দনায় সক্রিয় অংশ নিতে আমরা। আরেকবার জলঘড়ি মাপার ওখানে দাগকাটার সৌভাগ্য হয়েছিল। বড় পিতলের পাত্রে ফুটো বাটি ভাসত। ডুবে গেলে আবার প্রথম থেকে। কতবার ডুবলে সন্ধিপুজোর ক্ষণ আসবে জানতাম ন। অত ধৈর্য্য ছিল না। 

একচালা প্রতিমার সামনে সারাদিন চলমান চলচ্চিত্র। কলাবৌ পরে আসত তাই চালার বাইরে। সিংহ হত সাদা, কিছুটা ঘোড়ার মতো দেখতে। অসুরের গায়ের রং সবুজ। তবে সাত পুতুল— মানে সপরিবারে। গ্রামের কোথাও তিন পুতুল কোথাও পাঁচ পুতুলও হত। পুতুল কেন বলতাম? পৌত্তলিকতা! কিন্তু আমরা তো জানতাম খড়-মাটি-রং দিয়ে যা তৈরি হয়েছে; তার বুকে হাত রেখে পুরোহিত যেই মন্ত্র বলতে শুরু করেন ওটা পুতুল থেকে দেবী হয়ে যায়। আবার দশমীর দিন ঘট বিসর্জন হয়ে গেলে, বরণের পর শুদ্ধতা কমে যায়। আর প্রাণ থাকে না। তাইতো মন খারাপ করলেও বিসর্জন দিতে হয়। বিসর্জনের পর শান্তিজল ছেটানো হত, আম পাতার ডাল দিয়ে। তখন তো আমি হাফ প্যান্ট; তাই মায়ের আঁচল ঢাকা দিয়ে বসতে হতো। পায়ে যেন শান্তি-জল না লাগে। পা এত খারাপ কেন? কেবল বলির সময় ছাগলটার পা ধরতো মানুষ। দেখে মনে হতো টানাটানিতেই বুঝি ছিঁড়ে গেল শরীরটা। মোষ বলিও হত। কংকেশ্বরীর মাঠে। আসলে কনকেশ্বরী। গ্রাম দেবী। নবমীর দিন তিনি দর্শন দিতেন। মন্দির থেকে মাঠে যেতেন দোলায় করে। প্রচুর বাজি আর বলির পর ফিরতেন। তালপাতার স্পেশাল প্যাকিং করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছাত প্রসাদী মাংস। পেঁয়াজ রসুন ছাড়া রান্না হত।

নবমী না দশমীর দিন হতো কুমারী পুজো। আর পাতায় নাম লেখা ছাড়াও অন্যরকম একটা যাত্রা। বাড়ি থেকে নাড়ু মুড়ি বিলির এলাহি আয়োজন। এপাড়া ওপাড়া থেকে কতজন আসতেন। বস্তা বস্তা মুড়ি চলে যেত। কেউ কেউ আবার মুড়ি নিতে এসে ছোট ছোট মাছ সিঁদুর মাখিয়ে রেখে যেতে একটা বড় ঝুড়ি ঢাকা দিয়ে; ওই রকম একটা বড় মশারির তলায় আমরা প্রায় কুড়িজন মাথায় মাথায় ঘুমোতাম দোতলার বড় ঘরে। এদিকে লম্বা কাকু তো ওদিকে বেঁটে ভাগ্নি। গোটা মশারি বোধহয় কখনও ঘুমতো না। মেলার মতো। এক এক অঞ্চলে এক এক রকম মজা। কি অদ্ভুত সেই রাত্রি যাপন। মশারিটা কি অর্ডার দিয়ে বানানো হতো? নাকি পাওয়া যেত সেকালে? 

জানি না। জানি সিংহ আর অসুরের মতো পাল্টে গেছি আমরা। দেবী এখনও একচালারই আছেন। শুধু আমাদের সেই বড় মশারিটা আর নেই। গ্রামের বাড়ি যদিও বা যাই ছোটবেলার সেই উষ্ণতা আর জোটে না। প্রাণ প্রতিষ্ঠার মন্ত্র লেখা পাতাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!