দোলনচাঁপা দাসের দোদুল্যমানতা

চমক মজুমদার 

—আর কতদিন লোকের গু মুত সাফ করবি? এবার আমার সঙ্গে পালিয়েছে চ। দোলনকে নীচে ফেলে আঁচড়াতে আঁচড়াতে ফিসফিস করে ওঠে ইবাদুল। নাগিনের মতো ফোঁস করে ওঠে দোলন। নিজের দু-পা দিয়ে ইবাদুলের কোমরটা আরো পেঁচিয়ে ওর পিঠের উপর তীক্ষ্ণ নখ বসিয়ে দেয় দোলন,

—শালা হারামি, আপেল ফেরির পয়সায় আমায় খাওয়াতে পারবি? 

ঠিক এই সময়েই খাটের উপর শুয়ে থাকা বুড়ো লোকটা গোঁ গোঁ করে ওঠে। খাটের নীচে মেঝেতে মাদুরের উপর কাঁথা বিছানো বিছানায় আদরে ঢিলে দেয় ইবাদুল। দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকা কোমরটা থামিয়ে বলে ওঠে, ‘যা, তোর বুড়ো ডাকছে’। রাগী বিড়ালের মতো খিঁচিয়ে ওঠে ইবাদুলের শরীরে জড়িয়ে থাকা দোলন বলে

—কতবার বলেছি, কাজের মাঝখানে থেমে যাবি না। বুড়োর কথা ছাড়, তুই নিজের কাজ কর। 

উৎসাহ পেয়ে আরো জোরে নিজেকে আন্দোলিত করতে থাকে ইবাদুল। নর-নারীর ঘনঘন নিঃশ্বাস নিঃসৃত গরম বায়ু সঙ্গমরতদের উপরে যেন বাষ্পের চাদর তৈরি করে দেয়। সেই চাদরেরও উপরে, খাটে শুয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে এ বাড়ির বৃদ্ধ মালিক, দোলনচাঁপা যার আয়া। 

সঙ্গমের পর খুব জলতেষ্টা পায় দোলনের। ইচ্ছে করে ইবাদুলের বুকে মাথা রেখে শান্তির ঘুম দেয়। কিন্তু এতসব বিলাসিতা এই জায়গায়, এই মুহূর্তে শোভা পায় না। কাজ শেষ হলেই ইবাদুলকে নিজের শরীরের উপর থেকে সরিয়ে দেয় দোলন। দ্রুত ঠিকঠাক করে নেয় নিজের পোশাক। হাঁপাতে থাকা ইবাদুল তখন নিজের শিথিল শরীরের ঘাম মোছে। সব ঠিকঠাক হলে সন্তর্পনে ঘরের দরজার ছিটকিনি খোলে দোলন। অভিজ্ঞ হাতে কোনও শব্দ হয় না। রাতের অন্ধকারে হায়নার মতো চোখে চারপাশ দেখে নেয় ও। বুড়োর ঘরের বাইরেই বড়ো ডাইনিং হল। তার ওপাশে রান্নাঘর, টয়লেট, বসার ঘর। ডানদিকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতালায়। বুড়োর ছেলেরা দোতলাতেই থাকে। সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেট। গেট খোলা-বন্ধ করার আওয়াজ ঠিক বুঝতে পারে দোলন। চারপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে ইবাদুলকে ইশারা করে ও। তারপর সাবধানে ডাইনিং, বসার ঘর পেড়িয়ে ইবাদুলকে বাড়ির বাইরে বের করে সদর দরজায় শব্দ না করে তালা দেয়। বুড়োর ঘরে ঢুকে বোতল থেকে ঢকঢক করে জল ঢালে গলায়। বাথরুমে যায়। তারপর বুড়োর প্রস্রাব-পায়খানা মাখানো কাপড় বদলে দেয়। নতুন কাপড় পরিয়ে বুড়োর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে

—‘দাদু, জল খাবে?’ 

পরেরদিন ওই নোংরা কাপড় কেঁচে সকালের আয়া শ্রাবণীদি আসলে তবে দোলনের ছুটি। 

রোজ কাজের বাড়ি থেকে ছুটি পেয়ে দুর্গানগরের রেলপাড়ের বস্তিতে আসতে আসতে ইবাদুলকে ফোন করে দোলন। রোজ ফোনে ইবাদুল ওকে বলে

—এবার চলে আয়। রোজ রাতে আর লুকিয়ে...ভাললাগে না। অন্য কোথাও চলে যাবো দুজনে। তোকে আর কাজ করতে দেবো না। 

—কাজ না করলে খাবি কী? 

মুখে ঝাঁঝিয়ে উঠলেও এমন একটা দিন খুব করে চায় দোলন। রেলপাড়ের বস্তি, রিক্সাওয়ালা বর, রোগীর গু-মুত নিয়ে বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছে ও। ওর একটা মুক্তি চাই, স্বপ্নের মতো মুক্তি। ইবাদুল বোঝাতে থাকে

—এই কাজটা ছেড়ে শুধু ব্যবসাটাই করবো। তখন আর টাকা পয়সার চিন্তা থাকবে না রে। 


ইবাদুলের সঙ্গে দোলনের পরিচয়টা মাস ছয়েক আগে। একই ট্রেনে যাতায়াতের সূত্রে। দোলন কাজে যেত আর ইবাদুল কাছ থেকে ফিরত। রোজ একই কামরায় দেখতে দেখতে পরিচয়টা হয়েই গেল। স্টেশন থেকে নেমে পেশেন্টের বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যায় দোলন। পরিচয়ের পর থেকে দোলন আবিষ্কার করল ওর সঙ্গে সঙ্গে একই রাস্তা দিয়ে সাইকেলে ইবাদুলও যায়। পরিচয়টা ক্রমশ কথাবার্তায় মোড় নিচ্ছিল। আদান-প্রদান হয়ে যাচ্ছিল মোবাইল নাম্বার। 

রোজ বাড়ি ফিরেই দোলনকে জল ভরে রাখতে হয়। ততক্ষণ বাসি রুটি নিজের তৈরি করা চায়ে ডুবিয়ে খেতে খেতে ওর রিক্সাওয়ালা বর খ্যাচখ্যাচ কাজ করে,

—‘ওই এলেন সারারাত মারিয়ে’। 

আগে এসব কথা শুনলেই দোলনের মাথাটা গরম হয়ে যেত। বিশেষ করে ছেলের সামনে এসব কথা আগুন জ্বালিয়ে দিত মাথায়। ছেলেটা কেরালায় কাজে যাওয়ার পর থেকে নিজেকে অনেকটা দায়মুক্ত লাগে ওর। এই দমবন্ধ এঁদো ঘরটায় নিজেকে আটকে রাখতে চায় না ও। কার জন্য আটকাবে? ওই মাতাল রিক্সাওয়ালাটার জন্য? প্রতিদিন এই মানসিক অত্যাচার—উপরে নিজেকে শক্ত দেখালেও ভিতরে ভিতরে কতটা যে ভঙ্গুর তা নিজেই জানে পঁয়ত্রিশ পেরনো দোলন। 

শুধু আয়া সেন্টারের স্বপনদা মাস গেলে যখন টাকাটা দিতে আসে, তখনই দোলনের বরের সুর নরম। ইদানিং রিক্সা বেচে একটা টোটো কিনবে বলে ঘুরঘুর করছে। দোলন যখনই টাকাটা দেবে না, তখনই শুরু হয়ে যাবে—‘সারারাত কার সাথে শুয়ে টাকা রোজগার করিস আমি জানি না?’ 

এখন আর এসব কথা গায়ে জ্বালা ধরায় না দোলনের। ইবাদুলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর পুরোটা কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে ওর। শুধু মনে প্রাণে এই নরক থেকে বেরিয়ে ইবাদুলের স্বপ্নটায় যেতে চায় ও। ইবাদুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতেই দোলনের মনে মেঘ সরিয়ে কেমন এক ফালি রোদ দেখা যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে দোলনের ভিতরে ধ্বংসস্তূপে নির্মাণ হতে শুরু করেছিল। কেন এমনটা হল তার ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না ও। ব্যাখ্যা খুঁজতেও চায় না। 

দোলনের শরীর আঁটোসাঁটো, নিটোল বুক—নিজের শরীরকে আলাদা করে দেখার কথা মনে হয়নি ওর। সুযোগ যদিও ছিল না। কিন্তু দোলন জানে ওর শরীরের ভিতরে ধিকিধিকি আগুন আছে। আছে একটা হিসহিসিয়ে ওঠা সাপ। মাঝে মাঝে এই সাপ আর আগুনের কথা মাথায় এলেই দোলন নিজেকে জড়িয়ে ধরে, ছাই চাপা দিতে চায় ওদের। মেয়েমানুষ পুরুষের চোখ পড়তে পারে। আয়া সেন্টারের মালিক থেকে পাড়ার মুদি দোকানির চোখের ভাষা একই ঠেকে দোলনের কাছে। এতদিন সেই ভাষাকে কিভাবে স্তব্ধ করে দিতে হয় তার কসরত করে এসেছে ও। কিন্তু ইবাদুলের চোখের ভাষা যেন অন্যরকম। চোখের তারায় স্বপ্ন আঁকা আছে। 

ইবাদুল লোকটার স্ত্রী ওর সঙ্গে থাকে না—ছেড়ে গেছে অনেকদিন আগেই। ইবাদুল দিনে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করে। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টনারশিপের ব্যবসা। কিসের ব্যবসা তা অবশ্য পরিষ্কার জানে না দোলন। তবে বাংলাদেশ থেকে কিছু মাল নিয়ে আসে, আবার কিছু মাল এদেশ থেকে নিয়েও যায়। যাতায়াতটা যে চোরাইপথে হয় তা বিলক্ষণ বুঝতে পারে দোলন। তবে নিশ্চয়ই লোকটা সিধে রাস্তার নয়। তাদের দোলনের কিইবা যায় আসে! ও বুঝতে পারে লোকটা ভালো, অন্তত ওর কাছে। ওর পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে কেই বা স্টেশনে ওর জন্য রোজ অপেক্ষা করে! কে বাদামভাজা কিনে দেয়! 

দোলনকে একদিন দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে গিয়েছিল ইবাদুল। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল দক্ষিণেশ্বরের মাকে পুজো দেওয়ার। ট্রেনে গল্প করতে করতে ইবাদুলকে কবে যেন বলে ফেলেছিল দোলন। ইবাদুল নিয়ে যাবে কথা দিয়েছিল। মাঝে কিছুদিন ওপারে গিয়েছিল সে। ফিরেই দোলনকে বলেছিল—‘কাল চ পুজোটা দিয়ে আসি’। পরেরদিন ‘নতুন কাজের খোঁজে যাচ্ছি’ বলে পাটভাঙা শাড়ি পরে সকালেই বেরিয়ে পড়েছিল দোলন। ইবাদুল তো মুসলিম, তবে মন্দিরে পুজো দেবে কী করে—ভেবেছিল দোলন। সেদিন দোলন পুজো দিয়েছিল আর ওর সঙ্গে লেপ্টে ছিল ইবাদুল। পুজোর পর হোটেলে পেটপুরে বিরিয়ানি। আর তারপর সস্তা হোটেলের ঘন্টাচুক্তি ভাড়া নেওয়া ঘরের বন্ধ দরজার ওপারে প্রথমবার দোলনকে জাপটে ধরে ইবাদুল। 

—হিন্দু হলে আজকেই আমি তোকে সিঁদুর পরিয়ে দিতাম। 

দোলনের মনের মাঝে মেঘগুলো কথাটা শুনে ভারি হয়ে আসে। বৃষ্টি নামবে। জল যখন সদ্য পাতা ভেজাচ্ছে তখনই চোখ নামিয়ে পুজোর ডালি থেকে প্রসাদী ফুল নিয়ে ইবাদুলের মাথায়-বুকে ঠেকায় দোলন। 

—ওখানে আর থাকিস না। আমার সঙ্গে চল দূরে কোথাও, একসঙ্গে সুখে থাকবো।

হঠাৎ ওঠা ঝড় শব্দ করে খুলে দেয় দোলনের মনের দরজা। দেখা যায় ভেতরের ভগ্নস্তূপ। এ যেন আত্মসমর্পণ, এ যেন আহ্বান। আহ্বান—ধ্বংসস্তূপে নতুন ইমারত গড়ার। ঝড়ের মাঝেই বৃষ্টি নামে। দোলনচাঁপা দাস ভিজিয়ে দিতে থাকে ইবাদুল গাজীর চওড়া বুক। আর ইবাদুলের ব্যস্ত হাত, ব্যস্ত ঠোঁট ঘুরে বেড়ায় দোলনচাঁপার শরীরে। লোকটা কি সাঁপুড়ে? নইলে কীভাবে ঘুমিয়ে পড়া দোলনের শরীরী সাপটাকে জাগিয়ে তুলল? নিভন্ত আগুনে ফুঁ দিয়ে তুলল লেলিহান শিখা? না খেতে পেয়ে পেয়ে নাকি খিদেটাই মরে যায়। দোলন অনুভব করল তার খিদে মরিনি, ঘুমিয়ে ছিল মাত্র। আর তারপর কীভাবে ইবাদুল পুড়েছিল কামনার আগুনে, তা শুধু জানে ওর শরীরে দোলনের অগুনতি আঁচরের দাগ আর সস্তা হোটেলের এলোমেলো বেডকভার। 


খিদে পেলে বাঘিনী ঠিক উপায় খুঁজে বের করে। নদী সাঁতরে লোকালয়ে হানা দিয়ে তুলে নিয়ে যায় বাছুর। মানুষের হাতে আক্রান্ত হওয়ার ভয় তখন ছাপিয়ে মাথায় জায়গা করে নেয় খিদে। দক্ষিণেশ্বরের ওইদিনের পর ইবাদুলকে সরিয়ে রাখা দোলনের পক্ষে সহজ ছিল না। ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো ইবাদুলকে পেতে চায় ও। স্বপ্নটা ওকে ঘিরে ধরে। মুখার্জি বাড়ির বৃদ্ধ মালিককে গত এক বছর ধরে রাতে দেখভাল করে দোলনচাঁপা। কাজের দিক থেকে দোলনের বিশ্বস্ততায় তুষ্ট মুখার্জি পরিবার। তাই দোলনের হাতে বৃদ্ধ বাবাকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না ওরা। রাতে সিঁড়ির মুখের কোলাপসিবল গেট লাগিয়ে দোতালায় সুরক্ষিত থাকেন পরিবারের বাকিরা। নীচে একতলা আর বৃদ্ধ রোগী রয়ে যায় দোলনের হেফাজতে। দোলনও বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেয়। বাড়ির লোকের মতোই শুশ্রূষা করে বৃদ্ধের। দেখভাল করে একতলার। সকালে দোতলার লোক ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়িতে চলে আসে রান্নার লোক। তাই সদর দরজার একসেট চাবি থাকে দোলনের কাছেই। যদিও কোলাপসিবল গেটের চাবি ওর কাছে নেই। ওর নেই সচরাচর উপরে যাওয়ার অধিকারও। দোলনের মনে হয় এই অথর্ব বুড়োটার মতোই একতলাকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে এ বাড়ির লোকজন। আর তাই নামকাওয়াস্তে দোলনের বিশ্বস্ততার উপর সবটুকু ছেড়ে নিশ্চিন্তে থাকে বাজারের সোনার দোকানের মালিক মুখার্জিরা। ক্ষুধার্ত দোলন এই সুযোগটাই নিল। ওর এখন ইবাদুলকে দরকার। দরকার ইবাদুলের শরীরটাকে, ওর আঁকা স্বপ্নটাকে। আত্মগ্লানি এল না দোলনের—ও তো চুরি করছে না, ক্ষতিও করছে না কারোর। ইবাদুলকে বলতেই উৎসাহিত হয়ে উঠল ও। পকেট থেকে বের করে দোলনের হাতে এক প্যাকেট ওষুধ দিয়ে বলল, ‘রোজ রাতে একটা করে বড়ি বুড়োকে খাইয়ে দিবি। সকাল পর্যন্ত আর ঘুম ভাঙবে না’। সেই থেকে রোজ রাতে সবাই শুয়ে পড়লে, রাত গভীর হলে ইবাদুলকে ফোন করে দোলন। আশেপাশেই লুকিয়ে থাকা ইবাদুল সন্তর্পনে এসে দাঁড়ায় মুখার্জি বাড়ির সদর দরজায়। নিঃশব্দে খুলে যায় দরজা আর ও পা টিপে টিপে এগিয়ে চলে অভিসারে। রোজ রাতে খাটে ঘুমিয়ে থাকে বুড়ো আর মেঝের মাদুরে নর-নারীর শরীরী ঘর্ষনের উত্তাপ, উষ্ণ নিঃশ্বাস তৈরি করে যায় বাষ্পের চাদর। না রোজ নয়। মাঝে মাঝেই ব্যবসার কাজে বর্ডারের ওপারে যায় ইবাদুল। সেদিনগুলো একাই থাকে দোলন। সাথে থাকে নতুন আঁকা স্বপ্নরা। সেই দিনগুলোতে খুব ঘুমোতে চায় দোলন। 


ব্যাপারটা আর সহ্য হচ্ছে না দোলনের। বাড়ির অশান্তি যেন কিছুতেই থামছে না। আজ সকালেই টোটো কেনার টাকা চেয়ে দোলনকে পিটিয়েছে ওর বর। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে দোলন, রা কাড়েনি মুখে। কাজে যাওয়ার সময় দুর্গানগর স্টেশনে ইবাদুলকে দেখেই দরজাটা কেমন খুলে গেল ওর। ভেতরে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে এখন কাজ চলছে স্বপ্নের ইমারতের।

—আমাকে নিয়ে চল তোর সঙ্গে এখনই। 

মার খেয়ে কালশিটে পড়ে যাওয়া চোখের নীচটা দেখে আগুন জ্বলে ইবাদুলের চোখে। তবুও সে শান্ত গলায় বলে

—তাড়াহুড়ো করিস না। সময়ের জন্য অপেক্ষা কর। 

—আর কত অপেক্ষা করবো? এখনই নিয়ে চল। ফোঁস করে ওঠে দোলন। 

—তুই কি আমায় ফেলে পালিয়ে যেতে চাস? অবিশ্বাস জন্ম নেয় দোলনের গলায়। 


ইবাদুল কিছু বলার আগেই ট্রেন ঢুকে পড়ে প্ল্যাটফর্মে। হাওয়ায় এলোমেলো হতে থাকে দুই অস্থির মন। সারাটা ট্রেনপথ দোলনের হাতটা নিজের মুঠোয় ধরে রাখে ইবাদুল। কোনো কথা বলে না। অন্যান্যদিন মুখার্জীবাড়ির কথা, বুড়োর কথা আড্ডায় বলে দোলনচাঁপা। ইবাদুল দেখায় তার স্মার্টফোনে আসা মজার ভিডিও বা অশ্লীল জোকস। আজ বড়ো চুপচাপ দুজনেই। দোদুল্যমানতা হয়ত টেলিফোনকেও বোবা করে দিতে পারে। ট্রেন থেকে নেমে সাইকেল হাতে হাঁটার সময়ও সব চুপচাপই থাকে। মুখার্জিবাড়ির কাছাকাছি আসতেই ইবাদুল বলে, ‘রাতে তৈরি থাকিস। কাল ফার্স্ট ট্রেন ধরেই বনগাঁ যাবো দুজনে। বর্ডার পার করতে হবে।’ 


স্বপ্নগুলো জেঁকে বসে দোলনের মনে। আজ মুক্তি। একটা সরু সোনার চেন রয়ে গেল বাড়িতে—বিয়ের সময় মা দিয়েছিল। এ মাসে পাঁচ দিন কাজ করেছে আজকেরটা ধরে। আয়া সেন্টারের স্বপনদার সাথে হিসাবটা করা হল না। থাক গিয়ে এসব—মনে মনে ভাবে দোলন, নতুন করে আবার সব হবে। অন্যান্যদিন বুড়োকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজে একটু গড়িয়ে নেয় ও। আজ আর উত্তেজনায় ইচ্ছে করলো না। অন্যান্যদিন ওর কাঁধব্যাগটা থেকে চিরুনি, জলের বোতল বের করে রাখে ও। আজ সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরল। বুড়োর ঘরটা আজ একটু গোছালো। সময় যেন কাটছে না। বারবার কান খাড়া করে শুনছে উপরে সবাই ঘুমলো কিনা। অভিসারের পরিবেশ তৈরি কিনা পরখ করে নেয় দোলন, আজও তাই করল। তারপর ফোন করল ইবাদুলকে। ফোনে ওকে আসতে বলে শব্দ না করে সদর দরজার তালা খুলল। বাইরে ইবাদুল দাঁড়িয়ে। রাস্তায় স্ট্রিটলাইটের আলোয় ইবাদুলের অনেকগুলো ছায়া। ছায়াগুলো কি ইবাদুলেরই? দোলনকে ঠেলে বাড়িতে ঢুকে আসে ইবাদুল। দরজা ভেজিয়ে দেয়। 


—কি হলো চলো। দেরি করে লাভ নেই। অস্থির হয় দোলন।

—এখন কি ট্রেন আছে নাকি রে পাগলি? আগে এখন তোকে করি, তারপর তো ভোরবেলা...ইবাদুল পাঁজাকোলা করে নেয় দোলনকে। মুখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। দোলনও একই হাসি হেসে নিজেকে সমর্পণ করে। 

—দাঁড়াও, দরজায় তালা দিই। রাতের অন্ধকারে ফিসফিস করে দোলন।

—ভেজানোই থাক। আমার আর তর সইছে না। পাঁজাকোলা করে দোলনকে নিয়ে বুড়োর ঘরের দিকে প্রায় দৌড় দেয় ইবাদুল। 


নিজের সুরতন্ত্রীতে এত সুর আছে সেতার তা জানে না। বাদকের আঙুলের জাদুতে সে জানতে পারে নিজের সুরের মাধুর্য। দোলন জানতো বটে তার শরীরে আগুন আছে, কিন্তু সেই আগুন কী করে খেলতে হয় তা যেন ইবাদুল শেখালো আজ। লোকটা নিশ্চয়ই জাদুকর, নইলে আজ এই আনন্দের লগ্নে এত যৌনতা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল! সঙ্গমের গোপনীয়তা বজায় রাখতে দুজনেই নিশ্চুপে ভালোবাসে রোজ। কিন্তু আজ ঘনঘন শীৎকার আরো উত্তেজিত করে তুলছিল দুজনকে। চূড়ান্ত মুহূর্তে বুড়োর ঘরের দরজায় আলতো শব্দ—ঠকঠক। থেমে যায় দুই শরীর। উৎকণ্ঠা তখন উত্তেজনাকে ছাপিয়ে। আবার শব্দ। কেউ যেন টোকা দিল। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর দরজার ওপাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো,

—ইবাদুল ভাই? 

—কমপ্লিট? দোলনের ওপরে শরীরের ভারটা রেখে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করে ইবাদুল। 

—এক্কেবারে। 

—অপেক্ষা কর। আইছি। দ্রুততালে নিজের কাজ শেষ করে ইবাদুল। দোলন হতভম্ব হয়ে যায়। 

—রেডি হয়ে নাও। সময় হয়ে গেছে। দোলনকে বলতে বলতে নিজের প্যান্টটা পরে ইবাদুল। মাথা কাজ করছে না দোলনের। সে যন্ত্রের মতো তৈরি হয়। তুলে নেয় কাঁধের ব্যাগটা। 


দরজা খুলতেই দোলন দেখে বাইরে অপেক্ষমান তিনজন যুবক। পিঠে ব্যাগ। প্রত্যেকের মুখ রুমাল বাঁধা। ডানদিকে সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেটটা খোলা, তালাটা ভাঙা। 

—জলদি করো। ইবাদুল তাড়া দেয়। 

—তোমরা উপরে... সিঁড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে তোতলাতে থাকে দোলন। 

—ও কিছু নয়। একটু ঘুমের ওষুধ স্প্রে করা আছে। এখন চলো। 


ছেলে তিনটে সদর দরজার সামনে। ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। দোলনের নতুন গড়ে তোলা ইমারতটা আবার ভেঙে যাচ্ছে। আরেকটা ধ্বংসস্তূপ। এভাবে চোরের অপবাদ নিয়ে যায় কী করে দোলন! যারা ওকে খেতে দিল, তাদের বিশ্বস্ততার এই দাম দেয় কী করে! সামনে দাঁড়িয়ে ইবাদুল। তার ভালোবাসার লোভকেও উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই দোলনের। এই পুরুষের হাতেই তো ওর স্বপ্নের চাবিকাঠি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দোলন। দোদুল্যমানতায় দুলতে থাকে।

অলংকরণ : দীপ শেখর চক্রবর্তী