শেষ নাকি শুরু 

অতনু রায়


এক

তমোনাশ আর রাকা হানিমুনে এসেছে মানালিতে। ওদের বিয়ে হয়েছে একবছর হতে চললো। কাজের চাপ আর টার্গেটের চক্করে লম্বা ছুটি নিয়ে হানিমুন যাওয়ার সুযোগ হয়নি। টানা বারোটি দিন একসাথে একান্তে নিজেদের মতো করে থাকার জন্য ওরা মানালিকেই বেছে নিয়েছে। ওরা বললে ভুল হবে, রাকা প্রস্তাব পেশ করেছে আর তমোনাশ তাতে সমর্থন দিয়েছে। তমোনাশ আর রাকা একই অফিসে চাকরি করে। তমোনাশ সেলসে আর রাকা রিসেপসনিস্ট। অফিসেই আলাপ, প্রেম এবং অবশেষে বিয়ে। ট্যুর অপারেটর ঠিক করা থেকে ট্রেনের টিকিট সবটাই রাকা নিজের হাতে করেছে। তমোনাশ খুব ব্যস্ত থাকে। তাই ওকে এইসব থেকে রেহাই দিয়েছে রাকা। প্রথমে ট্রেনে করে দিল্লি, সেখান থেকে রাতের বাসে মানালি। ফেরার দিন ভাইস-ভার্সা। এই হচ্ছে প্ল্যানিং। মাঝের আটটা দিন শুধু ওদের দুজনের।


দুই 

সকালে রাকার ঘুম ভাঙল রুম-বয়ের কলিং বেল শুনে। ছেলেটির নাম ছোটু। মিস্টি ছেলে। বাংলা বোঝে, কিন্তু বলতে পারেনা। সকালের চা এনেছে। তমোনাশ তখনও ঘুমিয়ে আছে। রাকা দরজা খুলতেই ছোটু হাসিমুখে বলে, ‘‘গুড মর্নিং, মেমসাব।’’ এই অনাত্মীয় শহরে ছোটু কখন যে ওদের আপনার জন হয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি।

‘‘… ছোটু, কোনো খবর আছে?’’

‘‘নহি, মেমসাব। আজ ভি বাহর যানা মনা। অওর এক বাত, আজ আপকো ডক্টর কে পাস লে যানে কা ইন্তেজাম হো গয়া হ্যায়। আপ দশ বজে তইয়ার রহনা।’’ এই বলে ছোটু চলে যায়। রাকা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়।সামনে হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে আসার পর থেকে এতো নিঁখুতভাবে পাহাড় দেখেনি রাকা। অথচ আজ যখন এতো খারাপ সময়, তখন হিমালয় যেন আরো সুন্দর, আরো মনোমুগ্ধকর মনে হচ্ছে।


তিন

তমোনাশ ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই মোবাইলটার দিকে হাত বাড়ায়। প্রথমে নিজেরটা, তারপর একবার রাকার মোবাইলে চোখ বুলিয়ে নেওয়াটা এখন প্রতিদিনের অভ্যেস। এখানে আসার পর থেকে ওরা দুজনেই মোবাইল ফোনের নেট অফ করে দিয়েছিল। বলতে গেলে বাইরের জগৎ থেকে একপ্রকার নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেই রেখেছিল। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্য। এখন মোবাইল বন্ধ করে রাখা অসম্ভব। আজ সারা দেশে লকডাউন আঠারো দিনে পা দিলো। কবে ঘরে ফিরতে পারবে জানে না ওরা। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়ে খবরের খোঁজে। প্রতিদিন শুধুই নতুন নতুন করোনা সংক্রমণের খবর। নিজের ফোনে হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার যাবতীয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তমোনাশ রাকার মোবাইলের দিকে হাত বাড়ায়। রাকার মোবাইল স্যুইচড অফ। সে ইদানিং কেমন উদাসীন হয়ে গেছে, কোনো কিছুতেই উৎসাহ নেই। মোবাইলে চার্জ অবধি দিতে পারে না, মনে মনে ভাবে তমোনাশ। একটু বিরক্তই হয় বুঝি। আজকাল তমোনাশ সহজেই উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। ওর ইচ্ছে হলো রাকাকে ডেকে ফোনটা চার্জ দিতে বলতে। কাজটা সে নিজেই করে দিতে পারতো। তবু ইচ্ছে হলো। আর ঠিক তখনই একটা নোটিফিকেশন এলো টুং শব্দ করে। তমোনাশ হামলে পড়লো মোবাইলের উপর। একটা খবর এসেছে। একটা মেইল। যেটা দেখে তমোনাশ নিশ্চল স্থবির হয়ে গেলো ঐ হিমালয়ের মতোই। ভুলে গেলো রাকাকে ডেকে ফোন চার্জ দিতে বলার কথা। কখনো কখনো কোনো কোনো খারাপ ঘটনা, আরো অনেক খারাপ হওয়া আটকে দেয়। ওদের অফিস থেকে মেইল করেছে, ‘‘আপাতত নতুন করে কাজ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কোম্পানি কোনো বেতন দিতে পারবে না।’’ একে এই চরম দুর্ভোগ, তারপর বেতন বন্ধ। একেই বোধ হয় বলে 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা'। চব্বিশ দিন এই হোটেলের ঘর ওদের পৃথিবী। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা একা। ফোনে কিছু না বললেও ওরাও যে খুব সমস্যায় জর্জরিত বুঝতে পারে তমোনাশ। কিন্তু কী করবে আর কীভাবে করবে? আর ভাবতে পারে না। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। মুখটা তেতো হয়ে গেলো। ব্যালকনিতে রাকা দাঁড়িয়ে আছে। ওকে কীভাবে এই খবরটা জানাবে ভেবে পায় না। আজ আবার শহরের এ. টি. এম. থেকে টাকা তুলতে যেতে হবে। তমোনাশ বাথরুমে ঢুকে যায়।


চার

দশটার সময় ছোটুকে সাথে নিয়ে রাকা ডাক্তারের কাছে পৌঁছে যায়। দুজনেই মাস্ক পড়ে আছে। রাকার শরীরটা ক-দিন থেকেই ভালো যাচ্ছে না।:হঠাৎ পৃথিবীর সব ক্লান্তি যেন ওর ওপরে ভর করেছে। হোটেলের ম্যানেজারকে তমোনাশ ডাক্তার এর কথা বলেছিল। ম্যানেজারই অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে দিয়েছে। দুপুর দুটো পর্যন্ত প্রয়োজনে বাইরে বেরোনোর অনুমতি আছে। তাই রাকা আর তমোনাশকে সঙ্গে আনেনি। তমোনাশ আজ শহরের এ. টি. এম.-এ টাকা তুলতে যাবে। আর তাছাড়া ছোটু এখানকার রাস্তাঘাট ভালো চেনে। ওর সাথে কথা বলতেও রাকার ভালো লাগে। ওদের হোটেলটা বাহাং রোডে। শহরের ভিড়ের থেকে দূরে। নিরিবিলি অবসর যাপনের জন্য এই হোটেলটি রাকাই পছন্দ করেছিল। এখন মনে হচ্ছে শহরের প্রাণকেন্দ্র ম্যালের আশেপাশে কোনো হোটেলে থাকলেই ভালো হতো। যদিও ওদের হোটেলের ম্যানেজার আর অন্যান্য লোকজন খুবই ভালো। এই যে চব্বিশ দিন এখানে আছে রাকার মনেই হয় না বাইরে আছে।


পাঁচ

‘‘…কতদিন ধরে আপনার এই সমস্যা হচ্ছে?’’ হিন্দিতেই প্রশ্ন করেন ডাক্তার। রাকাও হিন্দিতে উত্তর দেয়, ‘‘দিন দশেক।’’ এর পর আরো কিছু প্রশ্নোত্তর এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষার পর ডাক্তার বলেন, ‘‘আমার মনে হয় আপনি কনসিভ করেছেন। আলট্রাসাউন্ড না করিয়ে কনফার্ম কিছু বলতে পারছিনা। এই মুহূর্তে সেই উপায়ও নেই। আপনি ইউরিন টেস্ট কিট নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে কাল রিপোর্ট করুন। তারপর ওষুধ দেবো।’’ রাকার মন আনন্দে ভরে ওঠে। তারপরের মুহূর্তে একরাশ বিষন্নতার মেঘ জমে। এই চরম আকাঙ্খিত মুহূর্তটিকে এই ভাবে আসতে হলো। হঠাৎই ওর মনে হলো। তমোনাশ যখন এই খবরটা শুনবে ওর কী প্রতিক্রিয়া হবে! ছোটুর সাথে রাকা হোটেলে ফিরে আসে।


ছয়

অ্যাকাউন্টের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। যতদিন যাচ্ছে খরচা বাড়ছে হু হু করে। এইভাবে আর ক-দিনই বা চলবে? লকডাউন পরিস্থিতি যদি আরো বাড়ে তাহলে চাকরিটা আদৌ থাকবে কিনা সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে তমোনাশ। তারপর কী হবে চিন্তায় ঘুম আসে না। অফিসের মেইলের কথাটা সে এখনো জানাতে পারেনি রাকাকে। দুপুরে ফিরে আসার পর থেকে রাকার সাথে কথাবার্তা বলা হয়নি সেভাবে। আর বলবেই বা কী? তাছাড়া রাকার শরীরটা ভালো নেই। এখন নতুন করে ওকে টেনশনে ফেলার মানে হয়না। রাকা ঘুমোচ্ছে। ‘‘আচ্ছা আজকে ডাক্তার এর কাছে কী হয়েছে?’’ সেটাও তো জিজ্ঞেস করেনি ও। এটা তো খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আসলে সকালে ঐ মেইল আর তারপর অ্যাকাউন্টের অবস্থা দেখে ওর আর মাথা কাজ করছে না। তমোনাশ চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে ব্যালকনিতে আসে। সিগারেট ধরিয়ে একটু স্বস্তি পেতে চেষ্টা করে। সামনে অন্ধকার পাহাড়গুলো ভারী মায়াবী মনে হয় অন্ধকারে। একটা ক্ষুদ্র ভাইরাস গোটা বিশ্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। মানুষের অহংকারকে দুমরে মুচড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, প্রকৃতির কাছে সে এখনো শিশু। তমোনাশের চোখগুলো জ্বালা করতে থাকে। ও এখন কাঁদতে চায় গলা ছেড়ে…


সাত

সকালে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো রাকার। টেস্ট কিট হাতে নিয়ে বসে থাকলো অনেকটা সময়। তারপর বাথরুমে গেল। ওর হার্টবিট বেড়ে গেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ফলাফলের। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জানা গেল ফলাফল পজিটিভ। এই অল্প সময়টা রাকার এক যুগ মনে হচ্ছিল। ভালো লাগা আর খারাপ লাগার একটা অদ্ভুত অনুভূতি ওকে গ্রাস করে। এবার টেস্ট কিট হাতে নিয়ে রাকা কেঁদে ওঠে।


আট

কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় তমোনাশের। তড়িঘড়ি উঠে বাথরুমের দরজা ধাক্কা দেয়— ‘‘রাকা, কী হয়েছে? দরজা খোলো…’’ রাকা দরজা খুলে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। তমোনাশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। রাকার হাতে ধরে থাকা টেস্ট কিট দেখে তমোনাশ সবটাই বুঝতে পারে। রাকা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘‘এভাবে কেন? এভাবে কেন?’’ তমোনাশ একজন বাবার মতোই বলে ওঠে, ‘‘দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে...।’’


অলংকরণ : সঙ্গীতা চন্দ