সোনাঝুরির অন্ধকারে

অঙ্কন রায়

দুর্গানবমী আজ। তবে এবছরটা অন্যরকম। এ বছর অতিমারির বছর। উৎসবের ভিড়, মাতামাতি, কিচ্ছু নেই। সন্ধের পর থেকেই লোকজনের আনাগোনা কমতে কমতে সোনাঝুরি বনের এই উত্তর পশ্চিম কোণ ঘেঁষে অবস্থিত আদিবাসী দুর্গোৎসবের মন্ডপটা অল্প অল্প ঝিমোতে শুরু করেছে। কাছে দূরে যে কটা খড়ের চালের অস্থায়ী ছাউনি দেওয়া দোকান, তাদের ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে দোকানদাররা। বেলিফুল হাঁসদা তার দোকানের কাজে আজ মন বসাতে পারেনি। তার কারণ অবশ্য অন্য। আজ দীর্ঘ দিন পর দিবাকরের সঙ্গে তার দেখা দুপুর একটা নাগাদ। তখন একটু লোকজন ছিল। মন্ডপের সামনে ঢাক বাজাচ্ছিল চারজন আদিবাসী ঢাকি। ইতস্ততঃভাবে ছড়ানো ছিটোনো দুচারটে খাবারের স্টল আর বাচ্চাদের খেলনার দোকানে কিছু কিছু মানুষের আনাগোনা চলছিল। বেলিফুলের বারোমাসের চায়ের দোকানে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের কয়েকজন তখনও আড্ডার রেশ কাটিয়ে বাড়ি ফেরেনি। সেই সময় দোকানের সামনে একটা আই টেন গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক ওই ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করছেন 'বেলিফুল নামে কোনও মেয়েকে তারা চেনে কিনা। সেটা শুনে বেলি নিজেই দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ভদ্রলোককে দেখে থ হয়ে গেল। দিবাকরদা!! এখনও তার নাম মনে রেখেছে দিবাকর?? 

'আ-আমি বেলি। তুমি দিবাদা না?' 

দিবাকর ঝট করে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে নীচে নেমে এসে বলল, 'বেলি! তুমি এখনও একরকমই আছো? কি আনন্দ আজ হচ্ছে আমার। তোমায় এসে এসেই দেখতে পাবো, ভাবতে পারিনি। চলো তোমার দোকানে বসবো। বসতে বলবে না?' 

একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতে হাঁফাচ্ছিল দিবাকর। বেলি ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। বিহ্বল দৃষ্টি। কোনওমতে কাঁপা গলায় বলল, 'এসো এসো। বসবে তো।'

দিবাকর বলেছিল 'একটু বসবো এখন। হোটেলে আমার ফ্যামিলি রয়েছে। এখনি ফিরতে হবে ওখানে। আমি শুধু তুমি এখনও এখানে আছো কিনা দেখতে এসেছিলাম। অনেক অনেক শান্তি পেলাম।'

ওদের কথার মাঝে স্থানীয় ছেলেমেয়েগুলো কখন যেন বেরিয়ে গেছে দোকান ছেড়ে। দিবাকর একটা বেঞ্চে বসে বেলিকে সামনে বসতে বলল। বেলি তখনও বিহ্বল। বসার কথা মনেই আসেনি ওর। তাকিয়ে আছে দিবাকরের দিকে একদৃষ্টিতে। দিবাকর জিজ্ঞেস করল, 'তুমি কেমন আছ বেলি? তোমার সংসারপাতি চলছে তো ঠিকমতন?'

'চলছে ওই একরকম। তারমধ্যে এই কয়মাস ধরে দোকানপাট বন্ধ ছিল, মানুষজন আসা যাওয়া করতো না... তবু বেঁচে আছি। বাঁচতে হবে তো, বলো দিবাদা। কতজনের দায়িত্ব নিয়ে রাখতে হয় মাথায়।'

দিবাকর কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর বলল, 'আমি রাতে একবার আসবো এখানে। তখন তোমার কথা শুনবো আর আমারও কিছু বলব। আমায় সময় দেবে তো বেলি?' 

বেলি সময় দেবে না, তাও আবার এতদিন পর হারিয়ে পাওয়া দিবাকরদাকে! এটা সম্ভব নয় বলেই এখন এই সাঁঝপেরোনো অন্ধকারে দুর্গানবমীর ঝিমিয়ে পড়া সোনাঝুরি বনের উত্তর-পশ্চিম কোণে দুর্গামন্ডপ ছাড়িয়ে খানিকটা ঘন ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে আরও গহীনে নিবিড়তা খুঁজতে গেল ওরা।...

ইদানিং  বেলিফুল হাঁসদার চায়ের দোকানটা ঝিমিয়ে থাকে। প্রথম প্রথম সেই মার্চে যখন থেকে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হল, জনবিরল সোনাঝুরি বনটা একেবারে জনশূন্য হয়ে গেল। তখন দোকান খুলতো না বেলি। খুলেই বা কি করবে? বাইরের গাড়ি করে ঘুরতে আসা ট্যুরিস্ট তো বন্ধই সেই সময়, এমনকি স্থানীয় কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরাও আর নেই সে তল্লাটে। সব, স--ব কিছু বন্ধ। বেলির তখন খুব মনে পড়তো দিবাদা'র কথা। দিবাকর রায়। কলকাতার সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটা। 'লোকটা' বলা যায় না ওকে, কারণ বয়সের বেশ কিছুটা ব্যবধান থাকলেও ওর চোখ, মুখ, শরীরের গঠনে সদ্য যৌবনের চাকচিক্যই লেগে থাকতো যা আকর্ষণ করতো বেলিকে। বেলির আর কতই বা বয়স তখন। বড়জোর অাঠারো কি উনিশ। অভাবের সংসারের কারণে তাকে কাজে নেমে পড়তে হয়েছিল। আশ্রম ইউনিভার্সিটির অনতিদূরেই এই সোনাঝুরি বনের একপ্রান্তে বেলিফুলদের ছোট্ট গ্রাম। একপাশে ক্যানেল আর অন্যপাশে সারি সারি সোনাঝুরি ও শালের গাছে পরিপূর্ণ এই খোয়াই অঞ্চলটা বাইরের ট্যুরিস্টদের কাছে এক অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। বনের ফাঁকে ফাঁকে কয়েক বছর ধরে শনিবারের হাট বসছে এখানে। আসেপাশের গাঁ গঞ্জ থেকে স্থানীয় মানুষজন তাদের হাতে তৈরি করা শিল্পকর্ম নিয়ে এই হাটে বিক্রি করতে বসে। সেই কারণে লোক চলাচল কয়েক বছরের মধ্যে অনেকটাই বেড়ে গেল। আর লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যাওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই অস্থায়ী ছাউনি দেওয়া কয়েকটা চায়ের দোকান, চপ/মুড়ি ঘুগনির দোকান গজিয়ে উঠলো এই বনের হাটকে ঘিরে। এই দোকানগুলো সবই বন লাগোয়া গাঁয়ের অভাবী মানুষেরা তৈরী করল, যার মধ্যে বেলিফুলও ছিল একজন। ওর বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানা নেওয়ার পর মা একা প্রচুর খাটাখাটনি করে সংসারের হাল ধরেছে, কারণ ছোট বেলি তখন স্কুলে পড়তো। বনের পাশেই ওদের আদিবাসী স্কুলে ক্লাস এইট অবধি পড়ার পর আর দূরে কোথাও পড়তে যাওয়ার সুযোগ পায়নি বেচারি। গাঁয়েই এর তার সঙ্গে গল্প করে, খেলাধুলো করে সময় কেটে যেত তার। 

আরও কিছুটা বড় হল যখন সে, মা বলল এবার কিছু কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। চাকরি পাক, না পাক, নিদেন একটা দোকানও যদি চা, চপ, মুড়ির দেওয়া যায় তাহলেও সংসারের অনটন কিছু কমবে। বাবা তো কাজ করতে পারে না। মাও বাবাকে সামলে, ঘর গেরস্থালী সামলে আর সময় পায় না। তাই বেলিফুলকেই সেই দায়িত্ব নিতে হবে। সেই সময় দিয়ে সোনাঝুরির সাপ্তাহিক হাটও আরম্ভ হয়েছে। তাই বিক্রিবাট্টাও হবে। আরও দু/চারজন গাঁয়ের বড়দের সঙ্গে কথা বলে শেষ অবধি তৈরী হল বেলিফুলের চায়ের দোকান। 

এই চায়ের দোকানেই একদিন আলাপ হয়েছিল কলকাতার দিবাকর রায়ের সঙ্গে। অল্পবয়সী বেলিফুলের সুন্দর মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল দিবাকর। কলকাতা থেকেই নিজস্ব গাড়ি ড্রাইভ করে তিনচারজন বন্ধু নিয়ে বেড়াতে এসেছিল সেবার দিবাকর। বেলিফুল তখন নতুন দোকানদার। নতুন নতুন ক্রেতাদের সঙ্গে ওর ব্যবহার ছিল মধুর, তাই যারা একবার ওর দোকানে আসতো, তারাই পরে পারমানেন্ট খদ্দের হয়ে যেত ওর চা, চপ, মুড়ির। সেই সঙ্গে ছেলে খদ্দেরদের একটা অতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল সে নিজে। স্থানীয় হোক বা ট্যুরিস্ট, অনেক ছেলেরাই ওর দোকানে বসে থাকতে ভালোবাসতো ওর সৌন্দর্যের সান্নিধ্য পেতে।

এমনিভাবেই দিবাকর রায়ও বেলিফুলকে প্রথম দেখার মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলো না। ফলে সেবার চলে গেলেও আবার আবার আসতে থাকলো সে। এরপর আসতো একা। বেলিও কেমন যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ছিল দিবাকরের প্রতি। আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় বদলে যাচ্ছিল। 

এই দীর্ঘ লকডাউনের মাঝে ঘরে বসে থাকতে থাকতে বেলির খুব মনে পড়ছিল সেইসব সময়ের কথা। তারপর একসময় লকডাউন উঠে গেলে দোকান আবার খোলা হল ঠিকই, কিন্তু খদ্দের নেই। দুচারজন স্থানীয় ছেলেছোকরা বা একঅাধটি মেয়েও সন্ধে নাগাদ এসে বসে ওর দোকানে। চা নেয় হাতে আর তুমুল আড্ডায় মেতে থাকে। উনুনের একপাশে মোড়া পেতে বসে থাকে বেলিফুল৷ বড্ড একা লাগে তার। ওই ছেলেমেয়েগুলোর কথা শুনতে শুনতে নিজের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। 

সেই সেবারের দুর্গাপুজোর কথা মনে পড়লে এখনও শিহরণ জাগে শরীরে। মনটা কেমন আকুলিবিকুলি করে ওঠে। স্পষ্ট মনে পড়ে উপচে পড়া ভিড়ে সন্ধ্যার আরতি হচ্ছে মন্ডপের প্রতিমার সামনে। প্রবল শব্দে বাজছে ঢাক। সঙ্গে কাঁসর। দোকানে মন নেই বেলির। সন্ধে পেরোতে না পেরোতেই ঝাঁপ ফেলে বেরিয়ে এসেছে। দিবাকর সময় দিয়ে রেখেছে। সেই সময় মতো তাকে তো যেতেই হবে দিবার সঙ্গে। যেতে হবে এক অজানা অভিযানে... যে অভিযানের কথা ও আর দিবাকর ছাড়া আর কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না। বেলিফুল, উনিশ বছরের দোহারা চেহারার মেয়েটা সেই পুজোর রাতে দিবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিল দুর্গামন্ডপের পিছনের রাস্তাটা ধরে আরও অনেক অনেকটা দূরে। সেই দূরত্ব থেকে ঢাকের শব্দ ক্ষীণ শোনা গেলেও পুজোর ভীড়, দোকানপাটের আলো ঝলমলে হৈ চৈ চোখে দেখা যাচ্ছিল না। উন্মুক্ত আকাশের নীচে কোন এক অপার্থিব মুহূর্তে নিজেরা আবরণহীন হয়ে একে অপরকে চিনছিল সেদিন বেলিফুল আর দিবা। সে চেনায় ছিল এক বর্ণনাতীত আশ্লেষ। বেলির নরম বুকের উপর মাথা রেখে দিবা শুনছিল তার হৃদয়ের শব্দ। সেই শব্দ ক্রমে উত্তেজিত করে তুলছিল দিবার পৌরুষকে। সে একটু একটু করে পান করছিল বেলির সদ্যপ্রস্ফুটিত যৌবন। চেষ্টা করছিল ধীরে ধীরে চরমে পৌঁছে পরিপূর্ণ করে পেতে তার সমস্ত আকাঙ্খাকে। আর ঠিক সেখানেই সেই পরম মুহূর্তে বাধা দিয়েছিল বেলি। দুহাতে চেপে ধরেছিল নিজের নিম্নদেশ। হিসহিসে গলায় বলেছিল দিবাকে, 'এখন নয় দিবাকর। এখন নয়। এটুকু রাখা থাক না আমাদের পরের দিনের জন্য। '...

আজ দুর্গানবমী। বেশ কিছু বছর পেরিয়ে এসে এবারের সময়টা অন্য। এবার পুজো হচ্ছে ঠিকই, তবে তার জৌলুশ নেই। নেই তেমন লোকসমাগম সোনাঝুরির আদিবাসী পুজোমন্ডপ ঘিরে। আছে শুধু বিগত কয়েকমাস ধরে জমাট বাঁধা অতিমারির অন্ধকার থেকে একটু একটু করে আলোয় ফেরার চেষ্টা। যদিও জানা নেই সে চেষ্টার ফল ফলতে আরও কতদূর পথ পেরোতে হবে। তবে আপাতত বেলিফুল আর দিবাকর নিঝুম নবমীর রাতে অনেকটা দূরের ঝোঁপজঙ্গল পেরিয়ে ওই শালবনের গায়ে একটা বাঁশের মাচার মতো আসনে আলতো করে বসলো। বেলি ঈষৎ অভিমানী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, 'এতদিন আসোনি যখন, এবার এলে কেন আমার কাছে? তোমার ফ্যামিলি আছে। নিশ্চয়ই ছেলেপুলেও হয়েছে। আমার কথা কেন মনে এল তোমার?'

দিবা একটু দোনামোনা মন নিয়ে হোঁচট খেতে খেতে বলল, 'আমি... আমি তোমাকেই দেখতে এসেছি বেলি। বিশ্বাস করো, এই কয়েক বছরের কাহিনী আমি পরে তোমায় বলব, সে এক ঝড় বয়ে যাওয়া কাহিনী আমার জীবনের। তবে এটুকু বলি এখনই, আমি বিয়ে করি নি। আমি জানি তুমি আমার জন্য বসে থাকবে না, কারণ আমি তোমায় কোনও খবর দিতে পারিনি এই ক'বছরে। নিতেও পারিনি।'

হতবাক বেলি অস্ফুটে বলে উঠলো, 'তুমি বিয়ে করোনি? তাহলে... তাহলে দুপুরে যে ফ্যামিলির কথা বলছিলে...'

হালকা হাসির রেশ ধরে দিবা বলল, 'সে ফ্যামিলিটা আমি, আমার বাবা আর মায়ের। আর সঙ্গে আমার এক পিসিও আছেন। আচ্ছা তুমি বলো, তোমার ফ্যামিলি হবার পরও তুমি এখানেই রয়েছো? সেই একাই দোকান করছো আগের মতো? কেন বেলি?'

বেলি মাথা নীচু করে বলল, 'আমার ফ্যামিলিও যে আগের মতোই আছে। আমার বাবা, মা আর আমি। তাই আমি দোকান ছেড়ে কোথায় যাবো?'

কিছুক্ষণের নিঃস্তব্ধতা। তারপর দুজন দুজনের হাত চেপে ধরে অবাক বিষ্ময়ে দেখতে থাকলো সোনাঝুরির অন্ধকার ক্রমশ এক অপার্থিব আনন্দময় আলোয় ভ'রে উঠতে শুরু করেছে। প্রবল ঢাকের শব্দে উৎসবমুখর চরাচর আবার ফিরছে তার পুরোনো উদ্দীপনায়।