সে শুধু গানের দিন

বিশাখা রায়

চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল সেই ফেলে আসা তিন বছর।

‘‘কণ্ঠে আমার কাঁটার মালা 

ফুলের মালা নয়

দুঃখ যাহার মাথার মুকুট 

ঝড়কে কি তার ভয়...।’’

সে সময়ে ডান্সিং ফ্রকের চল ছিল। একবার যদি সেই রেকর্ডের গান কানে গেছে, তবে যেন রিফ্লেক্স ক্রিয়ার মতো সেই ডান্সিং ফ্রকপরা মেয়েটা হাত ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে গলা মেলাত আর চোখ ভেসে জল উপচে পড়ত গাল বেয়ে। দাদারা তাই দেখে খুব মজা পেত। কেবল জ্যাঠা তেমন দেখলে কোলে নিয়ে নীচে নেমে রাস্তায় পায়চারি করে গান গেয়ে গেয়ে শান্ত করতেন সেই ফোঁপানো মেয়েকে। এই গানটি ‘দাদাঠাকুর’ ছবিতে প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া। লিপ দিয়েছিলেন সুলতা চৌধুরী। সুরের কোন্ মায়াময় হাতছানি যে সেই মেয়েকে অমোঘ টানে টানত আর কাঁদাত, তার কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই। মায়ের ঘুমপাড়ানি গানগুলোও খুব কাঁদাত...‘একবার গালভরা মা ডাকে, মা বলে ডাক মাকে’ অথবা ‘বলরে জবা বল, কোন্ সাধনায় পেলি শ্যামামায়ের চরণতল’। সেই সময়ে রেকর্ডে বাজত–‘ও ঝরঝর ঝরনা, ও রূপালি বরণা’ অথবা ‘সুন্দরীবনের সুন্দরীগাছ’। সেই গানে কিন্তু কান্না পেত না। আজ পুরনো গান নিয়ে লিখতে বসেছি কেবল সেই অধিকারে–যে সব তাল, সুর, লয়,গান আমায় জীবনভর কাঁদাল, ডোবাল, ভাসাল— আমি সঙ্গীতের কেউ না হলে সঙ্গীত আমাকে এমন যত্নে লালন করল কী করে!

বাড়িতে গানের আবহ ছিল। কিন্তু যাপনের সবটুকুই ছিল খুব চোখপাকানো, নিয়ন্ত্রিত। আমার আয়ত্তের মধ্যে ছিল একটা মাঝারি সাইজের মারফি রেডিও আর পরে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ছোট্ট একটা ট্রানজিস্টর। তাতেই চলত হরেক কিসিমের গান। রবীন্দ্রসঙ্গীত, খেয়াল, ঠুমরি, রাগপ্রধান, রম্যগীতি, লোকগীতি, কীর্তন, ছায়াছবির গান–কিছুই বাদ যেত না। নাটকও হত কত ভাল ভাল! যত তাড়াতাড়ি পড়া শেষ হবে, তত তাড়াতাড়ি গান শুনতে পাব, এই আশায় পড়াশোনা খুব চটপট সেরে ফেলতাম। হয়তো সেই কারণেই অত ছোট বয়সেই বেশ পরিণত হয়ে উঠেছিলাম। পরে ছোটমামা একটা টেপরেকর্ডার এনে দেওয়ায় রেকর্ড বাজিয়ে শোনার মজাও ছিল। বেশ মনে আছে, ন’বছর বয়সে ‘শ্রীরাধার মানভঞ্জন’ ঠোঁটস্থ করে ফেলেছিলাম। স্কুলেও অনেক গান শিখেছি শিক্ষিকাদের কাছে। তেমন ভাবেই শিখে নিয়েছিলাম রবি ঠাকুরের নৃত্যনাটকের গানগুলোও। সারা দিন সেই জগতেই থাকি তখন।

এর কিছু পরের ঘটনা। বিবিধ ভারতীতে ‘সাঙ্গীতিক’ নামে একটি অনুষ্ঠান হত। ছোট ছোট নাটকীয় মুহূর্তের সঙ্গে তিন বা চারটে গান লিখে পোস্টকার্ডে তা পাঠাতে হত। লেখা পছন্দ হলে তা নাটকের মতো করে পাঠ হত আর সেই সব গান বাজানো হত। প্রেরকের নাম-ঠিকানাও ঘোষিত হত। বেশ কয়েক বার সেখানে লিখে পাঠিয়েছিলাম। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে পোস্টকার্ড কিনে, তাতে লিখে পোস্ট করে দিতাম। অন্তত বার পাঁচেক তা নির্বাচিত হয়েছে ও সম্প্রচার হয়েছে। কিন্তু অন্য নামে আর অন্য ঠিকানা লিখে পাঠানোয় কেউ জানতেই পারেনি তা, এক-দু’জন বন্ধু ছাড়া।

   এই রকম ‘না’-এর গণ্ডিতে বেড়ে ওঠায় আমায় আকাশ দেখিয়েছিল, বাঁচতে শিখিয়েছিল গান। আমার পড়াশোনা ছাড়া আর কোনও কিছু করা বারণ ছিল। আমার নাচা, গাওয়া, কথা বলা –সব বারণ ছিল। চুপিচুপি ছবিও আঁকতাম। যার মাথার মধ‍্যে দিনরাত সুর খেলছে, সে কি আর চুপ করে থাকতে পারে? বছর  দশেক বয়সেই আবাসনের সবাইকে ডেকে, ঠিক করলাম রবীন্দ্রজয়ন্তী করব। বড়রাও এগিয়ে এল। আমি কিন্তু ক্যাপ্টেন হয়ে গেছি তখন। সবাইকে নাচ শেখাচ্ছি,গান শেখাচ্ছি। আমার এক বন্ধুদিদির বাবা তবলা বাজাচ্ছেন। সে কী উৎসাহ সবার! একবার তো হোরিখেলা করতে গিয়ে কেশর খাঁয়ের দিকে এমন রঙের রেকাবি ছুঁড়েছি যে, সে তো স্টেজেই ‘‘বাবা গো’’ বলে ঘায়েল। স্কুলেও তখন বার্ষিক অনুষ্ঠানে ‘পূজারিণী’-র ‘শ্রীমতী’ করছি।

সে বার ক্লাসে এক নতুন বন্ধু এল আমাদের কিছু পরে। কী সুন্দর দেখতে আর কত লম্বা! আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ও জেনে গেছে আমার গান-পাগলামির কথা। একদিন স্কুলে হঠাৎ হাফছুটি হয়ে গেল। আমাকে তো বাড়ি থেকে নিতে আসবে সেই সওয়া চারটেয়। বন্ধুটি বলল, আমাদের বাড়িতে চল। বাবা তোকে অনেক গান শোনাবে। আমার বন্ধুটি কিন্তু নিজেও অত্যন্ত ভাল গাইত। গানের লোভ কী আর সামলানো যায়! চললাম তার সঙ্গে এই শর্তে যে, আমাকে যেন যথাসময়ে স্কুলের সামনে পৌঁছে দেয় ও। কসবার কোথাও ওর বাড়ি। সেখানে আর কারা ছিলেন, কী খেয়েছিলাম, কিচ্ছু মনে নেই। কেবল মনে আছে, বন্ধুর বাবার মুখ, ওঁর গান আর হারমোনিয়াম বাজানো। এমন সুন্দর সৌম্য চেহারা, হাসিমুখের বাবা আমি কখনও দেখিনি। বাবা সম্পর্কে আমার মনে যে ধারণা গড়ে দেওয়া হয়েছিল, অর্থাৎ বিশ্রী ধরনের নিষ্ঠুর এক ছেলেধরা, যে কিনা খেতে দেয় না এবং দুষ্টু লোকের কাছে বিক্রি করেও দেয়, সেই ছবির সঙ্গে এই বাবা মিলল না। আমার বন্ধু তার বাবাকে আমার পরিচয় দিয়ে বলল যে, আমি অনেক গান জানি আর সবটা মুখস্থ। শুনে উনি কী পরম স্নেহে আমায় কাছে বসালেন, তা আমিই জানি। আমাকে গান গাইতে বললেন। তার পর নিজেও শোনালেন–‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক’। আমার তো মাথায় তখন বনবন করে ঘুরছে, কী ভাবে আবার ওঁর কাছে আসা যায়। 

বাড়িতে তো বলা যাবে না। এ সব জানলেই তো আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে সেই অজানা ভয়ঙ্কর ‘বাবা’র কাছে। অগত্যা আবার কোনও হাফছুটি বা অন্য কোনও ছলের অপেক্ষা। ওঁর গান শেষ হলে জিগ্গেস করেছিলাম, তুমি কি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়? খুব হেসে বলেছিলেন, না। আমি পাপড়ির বাবা। আরও কয়েক বার গিয়েছিলাম পাপড়ির সঙ্গে। তার পর আমার স্কুল বদল, অতএব বন্ধু বদল হল। আর পাপড়ি যে তার বাবাকে নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল! সবটাই বড় আকস্মিক।

বছর দুয়েক আগে কোন ফেসবুক বন্ধুর কোন পোস্টে একটা কমেন্ট ছেখে ছবিটা দেখতে ইচ্ছে হল। সেই প্রোফাইল খুলে দেখি, ওঁর মুখের আদল আমার সেই বন্ধুর মতো। সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করি। জিগ্গেস করি পাপড়ি কি আপনার কেউ হয়? উনি বললেন, আমি মহাশ্বেতা। পাপড়ি আমার ডাকনাম। আমি তো অভিভূত। ওকে পুরনো গল্পগুলো মনে করালাম। বললাম, তোর বাবা কেমন আছেন? উনি কি এখনও গান করেন? ও খুব অবাক হয়ে বলল, বাবা ভাল আছেন। উনি গান ছাড়া আর কী করবেন? এও বলল, তুই অমুক গ্রুপে খোঁজ করলে পাবি। দারুণ আনন্দ হল আমার। এর পর জানতে পারলাম, আমার বন্ধু পাপড়ি—ভাল নাম মহাশ্বেতা বন্দোপাধ্যায়—ও এখন বিখ্যাত গায়িকা। আর ওর সেই সৌম্যদর্শন হাস্যময় বাবা আর কেউ নন—সঙ্গীত জগতের স্বনামধন্য গীতিকার ও সুরকার অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়। আমার নিজস্ব চেতনায় আঁকা সেই সদাহাস্যময় স্নেহময় ভাল বাবা–আমার সঙ্গীতের পিতা। এত কথা বুঝিয়ে কাজ নেই। আমার ছোটবেলার গায়ে ছুঁয়ে থাকা সেই স্নেহ অক্ষুণ্ণ থাকুক। 

আর যোগাযোগ করিনি। এই করোনাকালে ওঁর নাতনি প্রিয়ম্বদা আজ ওঁকে লাইভে আনবেন। দূর থেকে সেই লাইভ দেখতে দেখতে চলে যাব স্মৃতিসরণিতে। আন্তরিক প্রণাম নিশ্চয়ই গুরুর অন্তর ছুঁয়ে যাবে। আগেই বলেছি, আমার বাড়িতে আমার সব কিছুই ছিল খুব মাপা–কতটা আকাশ দেখব, কতক্ষণ পুবের দিকে চাইব, কতটা উত্তরে–সব মাপা। সবটাই মেনে নিতাম। কেবল এই নাচ গান আঁকার বিষয়ে এই বাধা আমার অন্তর মানত না। তাই এই সব কাজকে আমার চূড়ান্ত অবাধ্য এবং একটা বখে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা হিসেবেই দেখা হত। 

এ বিষয়ে একটু গোপন সহযোগিতা পেতাম আমার বড়মামিমার কাছে। তিনি এবং আমার বড়মামা দুজনেই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের পড়ুয়া ছিলেন। হয়তো সে কারণেই তিনি আমার চাহিদাটুকু বুঝতেন। একবার বললেন, চল। পিসিমাকে দেখতে যাব। পিসিমা থাকেন মার্লিন পার্কে। নীল রঙের মরিস মাইনর চালিয়ে আমায় নিয়ে চলে গেলেন সেখানে। কী সুন্দর যে সেই বাড়ি! লন পেরিয়ে শ্বেতপাথরে মোড়া সে বাড়িতে ঢুকলাম। কত উঁচু সিলিং। সূক্ষ্ম কারুকাজের রেলিং ধরে সিঁড়ি উঠে গেছে। আমরাও উঠেছি। শান্ত বাড়ি। একটি ঘর থেকে ভেসে আসছে রেওয়াজ, যাকে চোখ বন্ধ করে ঝরনা ডাকনামে ডাকা যায়। উঠে এসে এক বিশাল ঘরে ঢুকলাম। সেখানে তাকলাগানো অপূর্ব অলংকৃত একটি পালঙ্কে একটু স্থূলাঙ্গী এক বৃদ্ধা শায়িতা। মামিমার সঙ্গে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম প্রশস্ত বারান্দায়। এলাম না, টেনে আনল সেই সুর। চুপিচুপি পর্দা সরাতেই দেখি, সাদা শাড়ি পরে চোখ বুঁজে ধ্যানস্থ হয়ে একজন গান গেয়ে চলেছেন পরপর...অতুলপ্রসাদী গান, রজনীকান্তের গান, দ্বিজেন্দ্রগীতি। প্র্যাকটিস শেষে ডেকে নিলেন। আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। জেনে খুশি হলেন। ইনি প্রখ্যাত হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা পরম সুকণ্ঠী কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়। আমার মামিমার বৌদি। 

এর পরেও বেশ কয়েক বার ওঁদের বাড়িতে গিয়েছি আর গানও শিখেছি। কিন্তু অমন ছোট্ট মুখ খুলে এত সুর যে কী ভাবে ঢেলে দিতেন তিনি, জানি না। শ্রদ্ধেয় হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আমার মা গান শিখেছেন। মামিমার কারণেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। একবার মায়ের উপস্থিতিতেই স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে। তিনি এসে বললেন–হরেনবাবু, আপনি গানগুলো শুনিয়ে যান। আমি নোটেশন নিয়ে নিচ্ছি। গান শেষ হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে নোটেশনও। উনি ওঠার উপক্রম করতেই মায়ের জ্যাঠামশাই অর্থাৎ হরেনবাবু বলে উঠলেন, আপনি একবার গাইবেন না? হেমন্তবাবু বলেছিলেন, আমার গান তোলা হয়ে গেছে। রেকর্ডে শুনে নেবেন।