কয়লাকুঠির দুগ্গোৎসব

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

রাঢ় বাংলায় পশ্চিম বর্ধমান জেলার অন্তর্গত ‘কয়লাখনি অঞ্চল’ বলে পরিচিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বহু বছর ধরে দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে৷

এক দিকে বনেদি বাড়ির বেশ কয়কটি পুজো যেমন আছে, অন্য দিকে বিখ্যাত কয়েকটি সর্বজনীন পুজোও অনুষ্ঠিত হয়৷ বনেদি বাড়ির উল্লেখযোগ্য দুর্গাপুজোগুলি হল : উখরা গ্রামের জমিদারবংশীয় হাণ্ডা পরিবারের দুর্গাপুজো, ভট্টাচার্য পরিবার এবং রায় পরিবারের দুর্গাপুজো৷ এ ছাড়াও সরপী গ্রামের জমিদারবংশীয় রায়চৌধুরী পরিবার, কুমারডিহি গ্রামের রায়চৌধুরী পরিবার, নবগ্রামের চট্টোপাধ্যায় ও চক্রবর্তী পরিবার, গোগলা গ্রামের জমিদারবংশীয় নায়ক পরিবার এবং গৌরবাজার গ্রামের জমিদারবংশীয় চট্টরাজ পরিবারের দুর্গাপুজো দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে নিজস্ব পরম্পরাগত ভাবে পালিত হয়ে আসছে৷

কয়লাখনি অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো হল উখরার হাণ্ডা পরিবারের পুজো৷ ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে স্বর্গীয় শম্ভুনাথ হাণ্ডা এই পূজার সূচনা করেন৷ একমাত্র কন্যার অকালপ্রয়াণ ঘটলে শম্ভুনাথ শোকার্ত হয়ে পড়েন৷ এর পর তিনি মা দুর্গাকে কন্যারূপে বরণ করে আনেন৷ ১৮০ বছর ধরে এখনও পর্যন্ত তাঁর উত্তরসূরিরা মাকে কন্যারূপেই বরণ করেন৷ মৃত্তিকা নির্মিত একচালার প্রতিমা, ডাকের সাজে স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারে সুসজ্জিতা মা এখানে অধিষ্ঠিতা৷ সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে পূজা হয় বলে এখানে বলিপ্রথা নিষিদ্ধ৷ এই পরিবারের পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, প্রথা অনুযায়ী বিজয়া দশমীর দিন বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য মাকে বরণ করেন এবং আরতি করে মাকে বিদায় দেন৷ 

উখড়া গ্রামে রায়বাড়ির দুর্গাপুজোর সূচনা করেন রামযাদব রায়৷ শতাধিক বছরের প্রাচীন এই রায় পরিবারের দুর্গাপুজো৷  এই পরিবারের মূল পদবি ছিল চট্টোপাধ্যায়৷ জমিদারি সূত্রে রামযাদব রায়কে ইংরেজ সরকার ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেন৷ বিগত আট পুরুষ ধরে রায় পরিবার এই পুজো করে আসছে৷ সম্পূর্ণ তান্ত্রিক মতে দুর্গাপুজো হয়৷ রায়বাড়িতে দেবীকে সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত চার দিনই অন্নভোগ দেওয়া হয়। সপ্তমীর দিন সাত রকম, অষ্টমীতে আট রকম  এবং নবমীতে নয় রকমের ভাজা মাকে ভোগ দেওয়া হয়৷ গোবিন্দভোগ আতপ চালের ভাত, বাড়িতে বানানো ঘি, আমের চাটনি, পরমান্ন ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি সহযোগে মায়ের ভোগ হয়ে থাকে৷ নবমীর দিন মাটির পাত্রে মাংস রান্না করে মায়ের কাছে ভোগ দেওয়া হয় ডাকিনী ও যোগিনীর উদ্দেশে ৷ দশমীর দিন মাছপোড়া এবং বাড়িতে যা রান্না হয়, তাই দিয়েই মায়ের ভোগদানের দ্বারা দেবীর বিজয়া দশমী পুজো সম্পন্ন হয়ে থাকে৷

শতাধিক বছরের প্রাচীন উখড়ার ভট্টাচার্য পরিবারের খ্যাপা মায়ের পুজো। শোনা যায় বর্ধমানের রাজার প্রধান পুরোহিতের পদ অলঙ্কৃত করতেন চ্যাটার্জি পরিবার৷ রাজপরিবারের দৌলতে তাই জমিদারির এক অংশ লাভ ক’রে এই পরিবার ‘ভট্টাচার্য্য’ উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন৷ পরে রাজার সঙ্গে মতানৈক্যের ফলে জমিদারির অংশ পরিত্যাগ করে এঁরা উখড়া অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। পরিবারের অষ্টম প্রজন্ম গঙ্গানারায়ণ ভট্টাচার্য মহাশয় ছিলেন পণ্ডিত ব্যাক্তি। তাঁর আমলেই খ্যাপা মায়ের প্রতিষ্ঠা হয়। এখানে মায়ের আটটি হাত ছোট, আর দুটি হাত বড়। 

কয়লাখনি অঞ্চলের অন্তর্গত পাণ্ডবেশ্বর থানার অধীনে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম নবগ্রাম৷ এই গ্রামে মোট ৫টি পুজো হয়। তবে তার মধ্যে ২টি প্রতিমাপুজো এবং বাকি ৩টি হয় ঘটপুজো। আনুমানিক প্রায় ১৬০ বছরের প্রাচীন এখানকার তিন শরিকের ব্যাঘ্রবাহিনী দুর্গাপুজো। এই পুজোর তিন শরিক হল চ্যাটার্জি, মুখার্জি ও চক্রবর্তী পরিবার। এই পুজোর প্রতিমা যাঁরা তৈরি করেন এবং যাঁরা ঢাক বাজান, তাঁরা বংশ পরম্পরায় ওই কাজ করে আসছেন। এখানে দেবী তপ্ত কাঞ্চনবর্ণের। 

পাণ্ডবেশ্বর থানার অন্তর্গত কুমারডিহি গ্রামে বড়থান ও মেজথানে রায়চৌধুরী পরিবারের দু’টি পুজো, ছোটথানে তাঁদের দৌহিত্র মুখোপাধ্যায় পরিবারের পুজো ও বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পুজো হয়। দ্বিজেন্দ্র রায়চৌধুরী ও তাঁর ভাই বিনায়ক রায়চৌধুরী প্রায় শতাধিক বছর আগে বড়থান মন্দিরে পুজোর সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে এই পরিবারের সদস্যদের একটি অংশ মেজথানে নতুন পুজো শুরু করেন। মুখোপাধ্যায় পরিবার ও বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে নতুন পুজো শুরু হয়। চারটি পরিবারের বাড়িতেই বোধন হয় সপ্তমীর ১৩ দিন আগে। রীতি অনুযায়ী, তাঁদের পুজোয় প্রথম থেকেই পুজোর প্রতিটি সন্ধ্যায় বাঁকুড়ার ভুলুই গ্রামের শিল্পীরা ‘জগদ্রামী রামায়ণ’ পাঠ-গান করতে আসেন। 

খনি অঞ্চলে শতাব্দী প্রাচীন বনেদী বাড়ির দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল সরপী গ্রামের রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো৷ পরিবারের এক সদস্য শ্রীকান্ত রায়চৌধুরী জানান, আনুমানিক দুশো বছর আগে অর্জুন সিংহ রায়চৌধুরী এই পুজোর সূচনা করেন৷ তান্ত্রিক বিধিতে পুজো হয় বলে এখানে বলিপ্রথা আছে৷ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এখানে মহিষ বলি দেওয়ার রীতি রয়েছে৷ এছাড়া উল্লেখ্য শীতলপুর কোলিয়ারি, মান্দারবনি কোলিয়ারি, মাধাইপুর কোলিয়ারি, বিলপাহাড়ি, খোট্টাডিহি সর্বজনীন ইত্যাদি পুজোগুলি।