মণ্ডপের পিছনেই যাত্রাপালা

মলয় মণ্ডল

তখন কত আর বয়স? ছয় বা সাত বছর হবে। বাড়ির সামনেই ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠেই দূর্গাপুজো এবং ক’দিন পরেই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে থাকত। 

তখন মহালয়া থেকেই স্কুলের ছুটি পড়ে। মহালয়ার কিছুদিন আগে থেকেই বাঁশের  নেড়া প্যান্ডেল বাঁধা। সেই প্যান্ডেলেই এমাথা ওমাথা করে পুজোর কটা দিন ছুটি কিভাবে যে কেটে যেত বোঝাই যেত না। পাড়ার বড়রা মহালয়ার আগের দিন রাতে ফিষ্ট করতো। আমরা যারা ছোটো তারা সবাই আমন্ত্রিত থাকতাম ওই ফিষ্টিতে। পাড়ার এমাথা থেকে ওমাথা বড় বড় চোঙা লাগানো হত সারা রাত ধরে যাতে পাড়ার সবাই মহালয়া শুনতে পায়। এখনকার মতো সেই সময় ঘরে ঘরে রেডিও টিভি ছিল না, তাই সেগুলো সবাই আনন্দের সঙ্গেই মেনে নিত। মহালয়ার আগমনী বার্তায় একটা খুশির হাওয়া বয়ে যেত। 

পরদিন ভোরবেলায় আমরা যারা পাড়ার ছোটরা ছিলাম ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম প্যান্ডেলে। সেই ভোর থেকেই আমাদের মধ্যে চলতো লুকোচুরি খেলা। কার বাগানে শিউলি ফুল ফুটেছে সেখান থেকে তা খুঁজে আনার ধূম লেগে থাকত। পুজোর কটা দিন বেশ বিন্দাস থাকতাম। কোনও পড়াশুনার বালাই ছিল না। শুধু খেলা আর খেলা। 

বড় ফাঁকা মাঠের একদিকে দূর্গামন্ডপ, আর তার ঠিক পেছনেই মেদিনীপুর থেকে একটা দল প্রতি বছরই আসত। তারা কোনো বছরে রাজা হরিশচন্দ্রের যাত্রা পালা, কখনও রামায়নের পালা, কখনও মহাভারতের পালা, আবার কখনও উত্তম সুচিত্রার জুটির কোনও বই বা  আবার কখনও সেই সময়ের হিট সিনেমা যাত্রাপালার রূপ দিয়ে আসর জমিয়ে দিত। ভিড়ও হতো বেশ। তবে সব বিনা পয়সায়। 

এক একজনের অভিনয় বেশ নজর কাড়তো। তাদেরকেই সামনে রেখে পুরো টিমটাই চলত। সবচেয়ে মজা লাগতো যখন মালার নিলাম হতো। কেউ কাউকে ছাড়ার পাত্র নয়। মালার ডাক শুরু হতো বিশ পঁচিশ টাকা থেকে। সেটা কোথায় থামত তার কোনও ঠিক ঠিকানা থাকত না। সেই মালা কয়েক হাজারেও বিকিয়ে যেত। এই ডাকের পর্বটাও বেশ মজার লাগতো। যাত্রাপালার লোকজনেরা ছড়ায় ছড়ায় এক একজনকে এমন তোল্লা দিত যে তারা আর পিছিয়ে আসতে পারত না। মালাগুলো মূলতঃ কিনত এলাকারই কয়েকজন ব্যক্তি। ওই ডাকের মালা কিনে তারাও যেন গর্বিত বোধ করত। তাদের নামগুলো  মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত কটা দিন। তাতেই ওদের আনন্দ। মালার ডাক থেকে পাওয়া অর্থটাই ওদের পেট ভরাত। এভাবেই চলে যেত কটা দিন। 

পুজোর সময়ে বন্ধুরা নতুন নতুন জামা প্যান্ট পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপর দিকে কোনও বছর কিছু জুটত, আবার কখনও জুটত না। তখন মনের মধ্যে কোথাও একটা যন্ত্রণা লেগেই থাকত। চরম দারিদ্রতার মধ্যে বেড়ে ওঠা। 

তখন সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। বাড়ির সামনেই বাজার, বাজার লাগোয়া রেড লাইট এরিয়া। পেটের তাগিদে বাজারেই এক পরিচিতের টেলারিং এর দোকানে জামা প্যান্টের বোতাম ঘড়া, হেম সেলাই এর কাজে লেগে পড়লাম। স্কুলের সময় বাদে বাকি সময়টা ওই দোকানেই কাটত। পুজোর আগে ছুটির সময় দুপুরবেলা দোকানে থাকলে কিছু উপায় হতো। দুপুরের দিকে রেড লাইট এলাকার মহিলারা এসে বলতো সায়াটা ডবল সেলাই করে দেবার জন্য, আবার কখনও বলতো ভাই শাড়ির ফলস পাড়টা বসিয়ে দেবে? এছাড়া আরও কত কিছু নিয়ে আসতো সেলাই করার জন্য। কাজ হবার পর পয়সা চাওয়াটাই হয়তো বোকামো, তাই বলতাম যা হয় দিন। যা দিত বেশিই দিত। আবার জিজ্ঞেস করত আর লাগবে? 

তারপর ধীরে ধীরে সবাই হঠাৎ বড় হয়ে গেলাম। হারিয়ে যেতে থাকল মহালয়ার আগের রাতের উন্মাদনা। হারিয়ে গেছে ছোট্ট বেলার কত বন্ধুও। এখন তো আর চোখেই পড়ে না সেই সব হুটোপুটি করে চোর পুলিশের খেলাগুলো। আর দেখা যায় না সেই সমস্ত যাত্রাপালাগুলো। এখন তো সবার হাতেই মোবাইল। যার নেই সেও উঁকি মারছে যার হাতে আছে তার দিকে। এখন আমরা যে পুরোপুরি নেটবন্দি হয়ে গেছি।

জানি না এবারে কি হবে? একদিকে করোনায় দেশ দিশেহারা। পাশাপাশি বিভিন্ন ছোটখাটো কোম্পানিগুলোর নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। বেকারীর সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। জানিনা কতজন এবারের পুজো উপভোগ করতে পারবে? এসব দেখেই মনে পড়ে যায় সেই ছোট্ট বেলার কথা। যেবার কোনও কিছু যখন জুটত না, তখন যেমন একটু অন্তরালে থাকতাম ঠিক সেই ভাবেই কত শিশু যখন বঞ্চিত হবে তখন মনে পড়বে সেই তাদের কথাই। যা মন খারাপই করিয়ে দেবে।