ঠিকানা  পুরুলিয়া

পারমিতা ভট্টাচার্য

‘‘এই বর্বর রুক্ষ বন্য প্রকৃতি আমাকে তার স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়াছে, শহরের খাঁচার মধ্যে আর দাঁড়ে বসিয়া থাকিতে পারিব কি? এই পথহীন প্রান্তরের শিলাখণ্ড ও শালপলাশের বনের মধ্য দিয়া এইরকম মুক্ত আকাশতলে পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় হুহু ঘোড়া ছুটাইয়া চলার আনন্দের সহিত আমি দুনিয়ার কোন সম্পদ বিনিময় করিতে চাই না।”

যত বার পুরুলিয়ায় যাই, ছোটনাগপুর মালভূমির যে-কোনও অঞ্চলে যাই, এই কথা ক’টা মনে পড়ে যায়। আমার তেইশ বছর বয়স থেকে পুরুলিয়া আমার দ্বিতীয় ঘর। আজও সেই প্রেম গেল না। আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল পুঞ্চা ব্লকের তিনটে ছোট্ট গ্রাম থেকে। সেই যাত্রা আজও শেষ হয়নি, হয়তো হবেও না। সেই প্রেমের গল্পই বলব। এখন যখন পুরুলিয়ার কোথাও যাই, টাকা দিয়ে থাকার প্রশ্ন প্রায় নেই। সর্বত্রই একটা যেন ঘর বানিয়ে ফেলেছি, যেমন অয্যোধ্যা পাহাড়, দেউলঘাটা, পাহাড়পুর। এই সব জায়গায় থেকেই, ঘোরা হয়ে যায় আরও নানা জায়গা। 

কোন ঋতুতে পুরুলিয়া যাব? প্রখর গ্রীষ্ম বাদ দিয়ে সারা বছর। বর্ষায় তার সবুজ, জল-ছলছল রূপ মনকে ভরে দেয়। শুকনো নদনদী তখন কূল ছুঁয়ে বয়, যা দেখতে বেশি মানুষ যান না। মনসা পুজো যদি সঙ্গে পড়ে, তা হলে তো পরবের ছোঁয়াও পাবেন। শীতে নিষ্পত্র গাছ আর শুকনো ঝরা পাতার খরখরানি, কুয়াশা মাখা সন্ধে, আগুন পোহানো রাত, ভেসে আসা গান, দেশি মোরগ বা হাঁস, সঙ্গে মহুয়া, আর কিছু চাই? শীতেই হয় বান্ধনা পরব। মকর সংক্রান্তিতে আছে টুসু পরব। বসন্তে? চারিদিকে আগুন জ্বলতে থাকে, পলাশ, শিমুল আর কুসুম ফুলের। টাটকা মহুয়া উঠবে তখন। মোরগ লড়াই তো আছেই।

আমার কাছে পুরুলিয়ার সবই সুন্দর, তাই বিশেষ দ্রষ্টব্যের দরকার হয় না। তবুও নানা জায়গায় ঘোরা হয়ে যায়, যার বেশির ভাগই সত্যিই কোনও না কোনও কারণে দর্শনীয়। সেই সব জায়গার বর্ণনা দিতে রাত কাবার হয়ে যাবে, তবু একটু ছুঁয়ে যাই।

অযোধ্যা পাহাড় : এখানে যেতে আমার অনেক দেরি হয়েছে। কিন্তু রাস্তার পাকদণ্ডীতেই মুগ্ধতার শুরু। শরতকাল, নীল সাদা আকাশ, আর চার দিকে সবুজ। থাকার ব্যবস্থা পাহাড়ের মাথায় পাণ্ডুর বাড়িতে, যদিও বেশ কিছু হোটেল, গেস্টহাউস আছে। একটু এগিয়ে গেলেই নকশা করা আদিবাসী গ্রাম, আদিগন্ত প্রান্তর চোখে সরষে ফুল দেখাবে। আর ছোট ছোট পাহাড়, তাদের বেড় দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে অজানা গ্রামে। পুজোর সময়ে সারা রাত ছউ নাচের পালা খোলা মাঠে। শেষ হয় যখন আলো ফুটতে শুরু করে। ওখান থেকে বেশ কাছে নীল জলের কয়েকটা ড্যাম, মার্বেল লেক, বামনী ঝরনা, মুখোশের গ্রাম চড়িদা। মার্বেল লেক আর বামনী ঝরনা থেকে ঘরে ফিরতে মন চায় না। আর এক দিকে ঠুরগার বন্ধ প্রকল্প, তার স্লোগানের দেওয়াল লিখন।

দেউলঘাটা : বসন্তকালে প্রথমবার গিয়ে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। দুটি প্রাচীন মন্দির ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে কাঁসাই নদীর পাড়ে। পাল যুগের তৈরি সম্ভবত। জৈন না শৈব, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। আরেকটি মন্দির ভেঙে পড়েই গেছে কিছু বছর আগে। মন্দিরগুলোকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য পলাশ আর শিমুল। চারিদিকে অনেক শিবলিঙ্গের উপস্থিতি। ওখানে পাশেই থাকেন এক মহিলা, একা। তিনি মন্দিরগুলো পাহারা দেন, কিন্তু আরও কিছু উদ্দেশ্য আছে কি না জানা নেই। ওঁর হেফাজতে আছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন পাথরের মূর্তি, পাশাপাশি ঘরে রাখা। চার পাশে ছড়িয়ে আছে মন্দিরের ভাঙা টুকরো পাথর। 

কিন্তু দেউলঘাটা যাওয়ার ওই শুরু। নদীর ও পাশেই তুন্তা গ্রামে আছে ভুবন আর ছোটুলালের থাকার জায়গা হিজুপে। খুবই সাধারণ ব্যবস্থা, কিন্তু আতিথেয়তা, আনন্দ, খাবার অতুলনীয়। আমার অবারিত দ্বার। তাই সুযোগ পেলেই বারবার যাই। বর্ষায় গেলাম, মন্দিরের চূড়াগুলো ঘাসে ঢেকে গেছে। নদী আর হেঁটে পেরোনো যায় না, ঘুরে যেতে হয় মন্দিরে। ওখানে বসেই সারা দিন কেটে যায়। শীতকালে মকর সংক্রান্তিতে তো সবথেকে বড় পরব টুসু। সবার বাড়িতে কুটুম। আগের রাত থেকে গান শুরু হয়েছে। পরদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টুসুর দোলা ভাসানোর আয়োজন। কী রঙিন উৎসব! মেয়েদেরই প্রাধান্য এই উৎসবে। দল বেঁধে সবাই চলল দোলা নিয়ে কংসাবতীতে ভাসাতে। নদীর পাড় লোকে লোকারণ্য। মেলা বসে গেছে এক বিকেলেই। সঙ্গে টুসু গান। 

দেউলঘাটার কাছেই গড়জয়পুর শহর, স্টেশন। ওই শহরেরও আনাচেকানাচে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। ওখানেও বিরাট  টুসু মেলা। মোরগ লড়াই।

বান্দা : রঘুনাথপুর ব্লকের এক কোনার দিকের এক গ্রামের প্রান্তে, পলাশ জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের এক অপূর্ব দেউল, সামনে একটা ভাঙা মণ্ডপ। মন্দিরের গায়ের কারুকার্য দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। বসন্তকালে না জানি কী রূপ নেবে এই জায়গা! গ্রাম পেরিয়ে, সরু জংলি পথ পেরিয়ে যখন দূরে মন্দিরের চূড়া দেখা দেয়, ফাঁকা পলাশ বনের মধ্যে, মনটা নেচে ওঠে। কোন হাজার বছর আগে হয়তো জৈন শ্রাবকেরা বানিয়ে গিয়েছিলেন এই অনবদ্য স্থাপত্য, আজও যা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

চেলিয়ামা : বান্দা থেকে ফেরার পথেই চেলিয়ামা গ্রাম। এই গ্রামে আছে একটি টেরাকোটার রাধাবিনোদ মন্দির, আর একটি মহামায়া মন্দির। এই মহামায়া মন্দির চত্বরে রাখা আছে অমূল্য কিছু পাথরের প্রাচীন মূর্তি, হয়তো বা বান্দার দেউলের মূর্তিগুলিই।

পাকবিড়রা : এই জায়গায় আমি গিয়েছিলাম, যখন আমার তেইশ বছর বয়স। জঙ্গলে ঢাকা ক’টি পাথরের মন্দির, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা মন্দির আর মূর্তির ভগ্নাংশ। তার কত বছর পরে গেলাম, সেটা বলা বারণ। তবে আমার সঙ্গে সঙ্গে পাকবিড়রার ভোলও আমূল পাল্টে গেছে। পরিষ্কার চার পাশ পাঁচিলে ঘেরা, মন্দিরগুলোর সংস্কার হয়েছে। কোথাও কিছু ছড়িয়ে পড়ে নেই, সে সব স্থান পেয়েছে পাশেই নতুন সংগ্রহশালায়। অসংখ্য জৈন মূর্তি ওখানে, সবচেয়ে বড়টি আকাশের নীচে সিধা দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু মানুষ এখন ওই জায়গাকে চেনে কালভৈরব বলে।

তেল্কুপি : সব থেকে কষ্ট পেয়েছি এখানে গিয়ে। অসংখ্য মন্দিরের সমাবেশ ছিল এখানে। দামোদর নদের তীরে। বাণিজ্যও চলত। কিন্তু আমাদের মহামান্য সরকার বাহাদুর পাঞ্চেত ড্যাম তৈরি করে সে সব ডুবিয়ে দিয়েছেন জলের তলায়। দুটি মাত্র জেগে আছে কোনওমতে ভঙ্গুর অবস্থায়। যাওয়ার রাস্তাও নেই। কিছু মূর্তি রাখা আছে পাশের গ্রামে। বহু যুগের ইতিহাস, গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে গেছে জলের আর বিস্মৃতির অতলে। 

এছাড়াও আছে পারডি, মুরগুমা, দোলাডাঙার প্রকৃতি, কাশীপুরের রাজ ইতিহাস, দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী, শীলাবতী  নদী। আর কত বলব?

রং, রূপ, বৈচিত্র, পরব, ইতিহাস... সব নিয়ে পুরুলিয়া! যাঁরা যখনই যান, তাঁদের বলব—থাকার জন্য আছে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা। 

গুগল বাবার সাহায্যে নিজের পছন্দ মতো জায়গা বেছে নিতেই পারেন। কিন্তু আবারও বলব, পুরুলিয়া কাউকে কখনওই নিরাশ করে না।

ছবি : লেখক