পুজো মানেই পারিবারিক পত্রিকা


পুজো মানেই পারিবারিক পত্রিকা

আবীর কর

তখন পুজো ছিল অন্যরকম। তখন পুজো ছিল আশ্চর্য রঙিন। সেই সময় নীল আকাশ জুড়ে সাদা মেঘেরা সত্যি-সত্যিই গোল্লাছুট খেলা খেলতো। কত সব অত্যাশ্চর্য ছবি ফুটে উঠতো শরতের আকাশ জুড়ে। শুধু কি রবীন্দ্রনাথ, রাবন-রাজার রথ ছিল, রাম-রাবনের যুদ্ধ ছিল, ছিল হনুমান আর গন্ধমাদন... এছাড়াও মনে মনে যা নিয়ে উণ্মাদন ছিল, মেঘে মেঘে ছিল তার ঠিক ঠিক প্রতিফলন। 

নদীর চরে সাদা কাশের অমল-ধবল মেলা আজও চোখ জুড়িয়ে দেয়। মনে মনে দেখে ফেলি মস্ত মেঘের নীচে ঋত্বিক ঘটকের ছায়াছবি। কিংবা নদীর চরে খানিকটা মিলে যায় কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ফ্রেম! কিন্তু সেই মন হু-হু করা আনন্দে যেন একপশলা বৃষ্টি হয়ে, সাদা কাশের ফুরফুরেপনাকে একটু ঝিমিয়ে দিয়েছে। এখনও ‘পুজো আসে, পুজো যায়’ সেই বয়সবেলার অনুভব না এলেও, বুঝতে পারি ‘পুজো আসছে, পুজো আসছে’র সেই তনুমনপ্রাণ জুড়ে যে আনন্দগান ছিল, তা যেন কিছুটা স্তিমিত। একেই হয়তো বলে বয়সবেলা। যদিও এবার একটু অন্যরকম, এক মহামারীর আতঙ্কে দীর্ঘকাল আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যহত। তারই মধ্যে ক্যালেন্ডার মেনে পুজো এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের দুয়ারে। হয়তো এবার উচিত ছিল, সরকারি ভাবে পুজো-উদযাপন বন্ধ করার সচেতনভাবে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার। 


কিন্তু আমাদের ভাগ্যে নিরপেক্ষ, স্বতন্ত্র সরকার বলে কিছু নেই, সব সরকারই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের তাঁবে। যাইহোক, সেই বয়সবেলার সময়কালে ফিরি, যখন ‘পুজো আসছে’র আনন্দ ছিল আশ্চর্যজনক ভাবে জমজমাট। কৈশোরের স্মৃতি জুড়ে আমাদের গ্ৰামের রাজবাড়ির প্রাচীন পুজো, রাজার সদর প্রাঙ্গণে বাঁধা শামিয়ানা, তার তলায় মঞ্চ বেঁধে যাত্রাপালা, নবমীর দিন রাজবাড়ীর কুলদেবী ষড়চক্রবাসিনীর কাছে শতাধিক ছাগবলি— পরে জেনেছি এই দেবী মা দুর্গারই কালিকা রূপ, যে কারণে আমাদের গ্রামে কালী-প্রতিমার পুজো নেই। নবমীর দিন আমাদের রাজবাড়ীর পুজোতে ভিড় করে আসে আশেপাশের যত গ্রাম। ভিড়ের মধ্যে আমি কোনওদিনই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনি। আর ওই ছাগবলি থেকে বরাবর তফাৎে। 

‘পুজো আসছে, পুজো আসছে’র সেই অনুপম আনন্দবেলায় আমার পুজোর চারদিন কাটতো মামাবাড়িতে। মামাবাড়িতে ছ’ঘরের দুগ্গা-দালানে হয় দুর্গাপূজা। বোঝা যায়, কোন এক সময় এই পুজো এক পারিবারিক পুজো ছিল। পরিবার বেড়ে এখন ছ’টি পরিবার সেই পুজোর প্রচলন রাখা হয়েছে। কোনওরকম প্রতিমা নেই, দুর্গার ছবিতেই পুজো। কিন্তু চারদিন ধরে পুজোর রীতি আচার, রকমসকম পরিপূর্ণভাবে নিবিড়ভাবে পালিত হয়। 

প্যান্ডেলের জাঁকজমক নেই, জমকালো আলো নেই, শুধু পুজো চলাকালীন এক একলা ঢাকি ঢাক বাজায়। কিন্তু সেই আড়ম্বরহীন ঘরোয়া পূজাটিকে ঘিরে বাড়ির বাইরে থাকা লোকজনেরা ঘরে ফেরে। গমগম করে ওঠে ঘর। দুগ্গাদালানের চারপাশে খাটিয়া, চৌকি পেতে চলে আড্ডা। ছ’ঘর মিলিয়ে শতাধিক জনসমাগম। নবমীর দিন পংক্তিভোজ, সে এক হইরই ব্যাপার। পুজোর কটাদিন আমার মামাবাড়িতেই তখন পঞ্চাশ-ষাট জনের উপস্থিতি। 

তখন শান্তিনিকেতনে পড়ি। ২০০১ সাল। পুজোর সময় ইচ্ছে হল, একখানা পারিবারিক পত্রিকা করার। নেমে পড়লাম। মামাতো মাসতুতো ভাইবোন মিলে লেখা হল, আঁকা হল। পুরোটাই হাতে লেখা। তারপর প্রয়োজন মতো ফটোকপি। শুভারম্ভ হল আমাদের পারিবারিক পত্রিকা— ‘সরযূ’র। সরযূবালা দেবী ছিলেন আমার মায়ের দিদিমা, তার সুর করে মহাভারত পড়া আজও কানে বাজে। আচার-আচরনে ভীষণ আধুনিক মনস্ক ছিলেন। ১৯৯৮ সালে একশো ছুঁই-ছুঁই বয়সে তিনি গত হন। তার নামেই পত্রিকার নামকরণ হল- ‘সরযূ’। আজও বহমান। এ’বছর সে পত্রিকা কুড়ির কোঠায় পা রাখলো। প্রথম দশ বছর আমিই প্রধান উদ্যোগী ছিলাম। ২০১০ সালে এক-দশক পূর্তিতে, দশ বছরের হাতে-লেখা পত্রিকার একটা মুদ্রিত সঙ্কলন-গ্ৰন্থ প্রকাশ করি। তারপর সে দায়িত্ব অনুজদের উপর অর্পন করি। আমরা এখন মামাতো-মাসতুতো ভাইবোন মিলে উনত্রিশ, আর ছানাপোনা মেলালে বেয়াল্লিশ। দেশ-বিদেশের নানান প্রান্তে থাকা ভাইবোনেরা বেশ কয়েকবছর হল আর সেইভাবে একত্রিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে সবাই যে যার জায়গায় থেকেও সাধ্যমত হাত লাগায়। বাঁকুড়ার রিম্পা, দুর্গাপুরের ঝিল্লি, কল্যাণী থেকে ডাম্পু, কলকাতা থেকে ব্রজ, বেঙ্গালুরু থেকে পল, ঝাড়গ্রাম থেকে ডিপ্লু... সব লেখা পাড়ি দিল ক্যালিফোর্নিয়ায় রুদ্র, বর্ষার কাছে। পুরুলিয়া থেকে তোর্ষা বা উত্তরপাড়া থেকে অর্পণের আঁকা দুর্গার মুখ প্রচ্ছদ-সজ্জায় সাজলো নিউ জার্সিতে, ডেবুর হাতে। এরপর আঁকা-লেখা পুনরায় ফিরল কলকাতার উপকন্ঠ ব্যারাকপুরে। ছাপা হল যাদবপুর বা হাওড়ার কোনও ছাপাখানায়। বিজয়া দশমীর দিন প্রণামের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বড়দের হাতে তুলে দেওয়া হবে একটি করে— ‘সরযূ’। উচিত মূল্যে। বড়দের কাছ থেকে পুজো দেখার টাকা নেওয়াটা এইভাবেই জারি রেখেছি আমরা, এখনও!

Post a Comment

0 Comments