পুজোর স্মৃতি : শারদোৎসব


শারদোৎসব

সমীরণ নন্দী

বর্ষার কালো মেঘটা সরে গিয়ে ঝকঝকে আকাশে তুলো তুলো মেঘ উড়িয়ে, হালকা, কখনো জোরালো বাতাসে নদীর ধারের সাদা কাশের বন দুলিয়ে, টুপ্‌টাপ্‌ ঝরতে থাকা শিউলি ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে; বাতাসে পুজো পুজো গন্ধটা যখন আসতে থাকে, শিশির ভেজা ঘাসের উপর ভোরবেলা যখন দেখি দু একটা শিউলি পড়ে আছে, মনের মধ্যে একটা কেমন কষ্ট ভরা আনন্দে ভরে ওঠে, ছোটবেলার কথাগুলো মনে পড়তে থাকে তখন বুঝি শরৎ এসে গেল। 

১৩১৫ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থাকাকালেই জানতে পারেন আশ্রমে সার্থক ভাবে বর্ষাউৎসব পালন হয়েছে। কবি আশ্রমে না থাকতে পারার বেদনা ঢাকবার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলেন শরৎঋতুর আবাহনের জন্য, শিলাইদহেই লিখে ফেললেন তিনটি গান। ১. আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়া..., ২. আনন্দেরি সাগর থেকে এসেছে আজ বান..., ৩. তোমার সোনার থালায় সাজাবো আজ দুঃখের অশ্রুধারা...। 

এল নাটকের চাহিদা, টানা আঠারো ঘন্টা লিখে সমাপ্ত করেন ‘শারদোৎসব’ নাটক (১৩১৫)। এই সময় থেকেই আশ্রমে ঋতু-উৎসবের প্রচলন হয়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, এই সমস্ত অভিনয়, ঋতুউৎসবের ভিতর দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে আশ্রমের ছেলেমেয়েদের একটি সহজ যোগ গড়ে উঠবে অগোচরে, অজ্ঞাতে— তাদের দৃষ্টি যাবে খুলে। আরও একটি উদ্দেশ্য হয়তো ছিল, এই সব উৎসব অনুষ্ঠানে যোগদানের মধ্যে দিয়ে ছাত্ররা ভুলবে তাদের প্রবাসকষ্ট। শান্তিনিকেতন হয়ে উঠবে তাদের কাছে ‘সব হতে আপন’।

ঠিক কবে থেকে এই পক্ষকাল ব্যাপী ‘শারদোৎসব’ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে জানি না। পুজোর ঠিক আগে গান, নাটক, কবিতা ও নৃত্যের অনুষ্ঠান নিয়ে প্রায় সমস্ত ভবনের যোগদানে সুন্দর ও প্রানবন্ত হয়ে ওঠে এই নাট্যোৎসব। সকলেই তো আর নৃত্য গীত, কবিতা বা নাটকে পারদর্শী নয় কিন্তু তারাও সক্রিয় যোগদান করে অথবা বলা ভাল করবার ব্যবস্থা থাকে এই অনুষ্ঠানে। এর মধ্যে একটি দিন নির্দিষ্ট থাকে ‘শারদোৎসব’ এর জন্যে। পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছাত্রছাত্রীরা অভিনয় বা বিচিত্রানুষ্ঠান মঞ্চস্থ করে ‘শারদোৎসব’ উদ্‌যাপন করেন। পনেরোদিন ব্যাপী এই নাট্যোৎসব শেষ হয় মহালয়ার দিন ‘আনন্দবাজার’ দিয়ে। সকলের সক্রিয় অংশগ্রহনের জন্যই শান্তিনিকেতন আজও ‘সব হতে আপন’। কালের নিয়মে শান্তিনিকেতনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ঋতু-উৎসবের তাৎপর্য্য আজও অমলিন। 

এই বছর করোনার কারণে অনেক ব্যতিক্রম হয়েছে। হয়নি ‘আনন্দবাজার’, হয়নি ‘শারদোৎসব’ কাছে দূরে থাকা ছাত্রছাত্রীরা দুঃখের শ্বাস চেপে রেখে অপেক্ষা করবে সামনের বছরের জন্য। শান্তিনিকেতন আবার আগের রূপে ফিরবে এই আশায়।  

ছবি : লেখক






Post a Comment

0 Comments