পুজোর কবিতা : দ্বিতীয় পর্ব


অনন্ত আখর

অনীশ ঘোষ

ছেঁড়াখোঁড়া যে জীবন বিষাদমোহগ্রস্ত

যেখানে মাটিতে মিশে আছে অনর্গল বালি ও কাঁকড়

এইমাত্র একটি কবিতার জন্ম হল সেখানে।

রুখাসুখা শরীরে যে জলের ইঙ্গিতকামী

ছায়া ও রোদের যুগপৎ মিলনপ্রত্যাশী

কীভাবে পুষ্ট হয় তার অযত্নবর্ধিত চর্চাখানি!‌‌


সর্বাঙ্গ জুড়ে বেড়ে ওঠা নষ্ট ডালপালা, ডানা

ক্ষয়ে যেতে যেতেও ঊর্ধ্বমুখী তবু কিছু ঐশ্বরিক লিপি

জল ও বাতাস আত্মস্থ করে গহীন নিষাদ থেকে

আশ্চর্য বৃত্তান্ত এ এক জীবনগামিতার

যে যাত্রাপথে অবগাহন সেরে রোদ ও বাতাস মাখে 

রণক্ষয়ী অনন্ত আখরগুলি.‌.‌.


প্রবাসে

সুবোধ দে 

তোমার শ্বাস- প্রশ্বাসে ওঠা-নামা করে আমার বুক

এখানে দমবন্ধ বেঁচে থাকার বাসনা ছুঁয়েছে সীমানা-ঘর

এক্ষণে রচিত হয় প্রতিবার বেঁচে ওঠার আবহ—


সুড়ঙ্গমুখে পাহারাদার বিভোর ঘুমে, বনকুল বন থেকে খুদে মাছি উড়ে এসে বসে প্রশ্নাতীত বাঁচার শরীরে,,

ধরে আছি এই স্বপ্নের কথা হুবহু—যেমন ঘুম এলে ছেঁড়া পাখনায় লেখে, কাকে চাও—!


যে আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে বিলম্বিত হয় ধুয়ে সাফ হবার বাসনা, ভ্রুণ দাগ জেগে রয় একা, 

একা একা এই নির্জন প্রবাসে, বছর ঘুরে গেলে—

অনায়াস জন্ম দেখে লোকে ভাবে, কার অবয়ব—!


কবি  

শতদল মিত্র

কবিটা রোজ মরে 

আর রোজ অশ্লীল বাঁচে 

তার মৃত্যুর অধিক জীবনকে সে সাজায় 

মৃত শব্দ দিয়ে, যা সেজে ওঠে ততোধিক মৃত অক্ষরে। 

লোকে হাততালি দেয়, বলে 

—আহা! কী মৃতুঞ্জয়ী কবিতা! 

কবি শোনে আর 

নিজের ছায়ায় মুখ ঢেকে ঘরে ফেরে মৃত্যুর সন্ধানে।  


এই ভাবে মরে বেঁচে, বেঁচে মরে কবি 

শুধু একবার কবির মতো বাঁচবে বলে 

যাবতীয় পাণ্ডুলিপি ছুঁড়ে দেয় চিতার শিখায়—

নেমে আসে রাস্তায় পরম নগ্নতায়, আগ্নেয় ঔজ্জ্বল্যে। 


কবি এই প্রথমবার জেগে ওঠে কবির পবিত্র সত্ত্বায়

শেষবারের মতো মরে যাবে বলে কবিতার ভূমায়!


না, হাততালি দেয়নি কেউ।


সময়ের হিসাব

অসিকার রহমান

কঠিন মুঠোর মধ্যে আছে সময়ের হিসাব

অথচ হিসাব মেলে না সারারাত।


পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধ বক

তাক করে বসে আছে আমার দিকে

সময়ের ডাকে

ভেঙে ফেলবে আমার অহংকার

(অবশ্য যদি না হিসাব মেলে)।


খুব কাছেই ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া

একটি নারীর মাথায় ফুল দেখে

ফুলের কথা ভাবছি

এমন সময় একটি বক ‌মুহূর্তে এসে

আমার একটি চোখ উপড়ে নিল।


কঠিন মুঠোর মধ্যে আছে সময়ের হিসাব

অথচ হিসাব মেলে না সারারাত


রাখাল 

গৌতম দাস

এক দিক দিয়ে ঢুকে 

অন্য দিকে বেরিয়ে যাওয়ার নাম গলি।


জাদুবাস্তবতার এদেশে 

কথাকলি গলির সকলে জানে 

                                 চোখে ধুলো দিতে।


অদ্ভুত পিরিতে 

একেক দিনের গায়ে সাঁটা থাকে 

একেক পোস্টার -

লোক হাসানোর।

                         হাসানোর ফাঁকে 

যে কোনো রকমের চলাচলের 

                     একটা মগ্নতা তো থাকে—


যা পৃথিবীকে নিবেদিত হয়েছে আজও।


পৃথিবীর বুকে পৃথিবীর জন্য এই যে পদক্ষেপ,এই যে মগ্ন মনোরথ 

                      তা ওই গলি থেকেই শুরু।


ভুরু নাচায় আবছায়া দেয়ালেরা 

গুরু ধরে পাপী পেটের আড়াল।


গলিতে গলিতে ভেড়া 

চড়িয়ে ফেরে শ্রীযুক্ত জাদুবাস্তব রাখাল।


কষ্ট

অসীম শীল

কোন কষ্ট আর কষ্ট থাকে না, থাকে না ভয়

হারানো ধন ফেরাবার যেটুকু তাগিদ সেখানেই সংশয়

চিতায় সাজানো কাঠ আমার অহমিকা

নিভৃত শয়ানে। জ্বলন্ত আগুন লেলিহান শিখা।


শরীর মন্দিরে

ফাল্গুনী ভট্টাচার্য

শরীর ভাণ্ডারে শরীর তালাচাবি শরীর মাধ্যমে খোলে শরীর

শরীর দরজার খুললে অর্গল শরীর মন্দিরে যায় ফকির

শরীরে সে পুরুষ শরীরে সে প্রকৃতি পঞ্চতত্ত্বের সম্মিলন

শরীর কামানল শরীরে শতদল চন্দ্র সূর্যের আবর্তন

শরীর উপাসনা শরীর দীপারতি শরীর জপে ব্রত উদযাপন

শরীরে এককোণে মনুয়া পাখি নাচে এত যে কাছে তবু নয় আপন।

শরীর বারাণসী শরীরই তীর্থ শরীরে মণিপুর মোক্ষধাম

জানি না চেতনা কী মনের মহিমা কী শরীর নিয়ে আছি দিবসযাম

শরীর আবাহন শরীর আচমন শরীর নিবেদন শরীর ধ্যান

শরীর মায়াঘুম শরীর জাগরণ শরীর শিহরণ ব্রহ্মজ্ঞান

শরীরে কাঁদাহাসা ঘৃণা ও ভালোবাসা শরীর অবসানে ভস্মশেষ

চৌদ্দ ভূবনের ভ্রমণ পরিশেষে অনল-অনিলের খেলা বিশেষ

শরীরকে মারতে শরীরই শস্ত্র। জন্ম দিতে-নিতে শরীরাধার

শরীরই পৃথিবী শরীর মহাকাশ শরীর শূন্যতা দুঃখাগার।

শরীর মায়াটান শরীর নির্বাণ, আগম-নিগমের সারাৎসার

শরীরে তিন নদী গোপনে বয়ে চলে ওপারে গেলে খোঁজো কর্ণধার


শরীর মধুময় শরীর হলাহল শরীর কামকলা- লীলাঙ্গন

ডোমের মেয়ে তুমি হেঁয়ালি ছাড়ো দেখি, রসিকা হয়ে দাও আলিঙ্গন।


ছবি

দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায়

যখন তুমি চুপটি থাকো

মেঘের বুকে বৃষ্টি আঁকো

তখন আমি ঘাসের স্মৃতি

শেকড় ধরে হাঁটি

চোখের পাতা গ্ৰীষ্ম শেষে

একটি ভাদ্র ব্যথায় মেশে

বিষণ্ণ সে প্রজাপতির

ডানায় খুঁজি মাটি।

ক্লান্ত আমি মহুল শুঁকে

সূর্য ওঠা গন্ধ মেখে

গভীর ফাট পূর্ণিমাতে

যুবক অবিরল

তুমিও যদি এমনি করো

আয়না ছোঁয়া মুখকে ধরো

সাঁতার দিয়ে কেমন করে

আঁকব আমি জল?


রসায়ন

পলাশ গঙ্গোপাধ্যায়

পায়ের ওপর পা

ঠোঁটের ওপর ঠোঁট

ছুটছে ঘোড়া ছুটছে

হয়ে গেল মহাজোট


দরজা জানলা বন্ধ

বারুদ কোথায় পুড়ছে

বুকের ভেতর বলিরেখা

সমুদ্র হয়ে ঘুরছে


ধোঁয়া কেন্দ্র 

জ্যোতি সেন

কাল সারারাত 

সাতরাগাছি বাস স্টপে

ট্রাফিক আটকে 

বুড়ো বট গাছ। 


তীব্র দূষণে

তিলত্তোমার  গর্ববোধ

গাড়ি গুগানি  শক্তিক্ষয় 

ধোঁয়া পাইপের প্রশ্বাসে ।


কাল সারারাত খুব খেটেছে 

দায়গ্রস্ত পিতা

ভোরবেলাতে বাসনপত্র 

উবুড় করেছে রাস্তাতে। 


ভোররাত জেগে

বট গাছের আজ

সকাল সকাল  হল না ওঠা 

মেঘলা আকাশ গায়ে জ্বর জ্বর 

পিঠে কোমরে অসহ্য ব্যাথা।


আজকে  কি রান্না হবে?

গাছের ওভেনে কালো ধূলিকণা

বয়স্ক মা জল ভরলেও

ওপাড়া থেকে কে আনতে যাবে?


 না জ্বললে উনুন 

উনুন  ভেঙে ফেলা 

যেমন ভাঙে   গাড়ি

গাছের  ডালপালা। 


এবার একটু বাইরে বসি, সূর্যতাপ

শিশির কুয়াশায় মাথা ধুয়েছি 

পাখির পালকে হাতপাখা 

একটু লবন একটু চিনি 

এবার একটু  ঝোল মুড়ি। 


সাতরাগাছি, বাস স্টপে 

ভয় পেয়না তিলত্তোমা 

আমার মত আরও অনেক সঙ্গি আছে 

সড়ক গাড়ির ধোঁয়া খেতে।


বর্ষা এলে বৃষ্টি আবার 

পাতার কালি দেবে ধুয়ে

ম্যানহোল তুমি সজাগ থেকো 

আবর্জনা  ঐ গঙ্গা জলে।


নারীকথন

ঝিলিক কর্মকার

ছেলেমানুষী মুখের ছাপ মুছতে পারে না।

তবু আছে দাম্পত্য

প্রজনার্থা উপাধি

ছাপা শাড়ির ভাঁজে অন্য রং।


'সুলতানার স্বপ্ন' সবুজ পাহাড়ে ধাক্কা খায়।

তবু সত্যবতী বেড়া ভাঙে

বিনোদিনী অধিকার প্রত্যাশী

কপিলা ভাসে কুবের জলে।


সোহাগী পথঘাট ঝরা ফুলে বাঁধা।

কনকচাঁপার নরম দেহ

শালুকের লাবণ্য

সদ্য ফোঁটা বয়ঃসন্ধি খোলস হারায়।


মাছ মেয়ের সবুজ চুল সমুদ্র পাড়ে।

দূর নাবিকের কম্পাস

দুলতে থাকা এক বুক

দাম্পত্যে খড়িমাটি আলপনা সাজায়।


ইচ্ছে করে

শিবানী মণ্ডল 

তারের ওপর ফড়িং বসে আছে 

ইচ্ছে করে ওদের ধরে রাখি,

ডোবার ধারে জল জমলে পরে

দু'হাত দিয়ে শুধুই কাদা মাখি।


মাছের পাখা সাঁতার কেটে বেড়ায়,

ইচ্ছে করে আমিও সাঁতার কাটি,

ধানের আগায় শিশির ফোঁটা জমে

সাজিয়ে ওদের করছে পরিপাটি।


ভোরের বেলা শিউলি ঝরে পড়ে,

ইচ্ছে করে কুড়িয়ে ভরি সাজি,

কাশের দোলা লাগলে মনে মনে

কাশ ফুলেদের সঙ্গে যেতে রাজি।


রাতের আকাশ একটু গাঢ় হলে,

ইচ্ছে করে জোনাক পোকা হই,

জুঁই ফুলেরা সঙ্গী হলে পরে 

ওদের সাথে মনের কথা কই।


পাহাড়পুরে বৃষ্টি যখন তখন

ইচ্ছে করে বৃষ্টির গান গাই,

গানের সুরে আসুক  প্রজাপতি 

নাচুক তালে এইটুকু তো চাই।


স্বপ্ন মাখা ভোরের আলো দেখি,

ইচ্ছে করে বাতাস হয়ে ভাসি,

মিষ্টি রোদের গন্ধ পেলে পরে

খালি পায়েই বেরিয়ে পড়েন চাষী।


তোমার মুখমণ্ডল

মধুমিতা রায়

তোমার মুখমণ্ডলের চারপাশে

গজিয়ে ওঠে সবুজ কচি পাতা,

কারা যেন ভোররাতে এসে

তার পাশে রেখে গেছে

সম্মোহনী নিস্তব্ধতা।

তোমার মুখ -

উড়ে বেড়ায়

রাস্তার একপাশে নীরব শুয়ে থাকে

আবার দেওয়ালে ছবির মতো ঝুলতে থাকে,

আমি তার পাশে চুপ করে শুয়ে পড়ি

দু'চোখ ভরা জিজ্ঞাসা নিয়ে

ঝাঁকড়া চুলে বিলি কেটে যায়

অনিশ্চিত দুচারটে আঙুল-

আর আঙুলের বাঁকে বাঁকে জন্ম নেয়

আদিম ধান দূর্বা।


যদিও সময় ক্লান্ত

প্রতিভা গঙ্গোপাধ্যায়

অশান্ত ধারালো অন্ধকারে ভিজেছে শরীর,

উন্মত্ত হিংসায় হৃদয় উঠেছে জ্বলে,

 মনের ছুঁয়ে আছে অচেনা উত্তাল আঘাত।

নির্বাক ঠোঁটে জিজ্ঞাসারা এসে জমাট বাঁধে।


যদিও সময় এখন ক্লান্ত,

অনিশ্চিত পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে,

আড়চোখে তাকায় আগামীর দিকে।

তবুও দূরে পাহাড়ের কোলে ঢেউ তোলে ইচ্ছেনদী

ভোরের আকাশে মন খুঁজে নেয় নক্ষত্রের ডাক।


নড়বড়ে রাতের আঁধার ঠেলে,

পাড় হই জীবনের  সাঁকো। 

আত্মবিশ্বাসের আঁচল বিছিয়ে,

অনায়াসে সকলের জন্য পেতে চাই অফুরন্ত সূর্য।


দেখা

বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কথা ছিল কি

তবুও দেখা হল—

তোমার সঙ্গে আমার কথা হওয়ার কথা ছিল না

তবুও কথা হল, কেননা

এই অচেনা শহরে পা রেখে তুমি প্রথম খুঁজে পেয়েছিলে

তোমারই মতো অসহায়, অনিকেত একটি মানুষ

সব রাস্তাই যাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়

আর তাকেই তুমি জিজ্ঞেস করলে পথ?


বলে দিতে পারি,

সব পথ আমি চিনিয়ে দিতে পারি—

যদি তুমি রাজি থাকো হেঁটে যেতে বহুদূর

আমার অনন্ত অনুভূতির অন্দরে অবিশ্রাম


Post a Comment

0 Comments