পুজোর কবিতা : প্রথম পর্ব



তৃষ্ণা 

সুদীপ্ত মাজি

অনেক পিপাসা আর ঘড়াভর্তি দুঃখ নিয়ে 

সীমানার চৌকি পার হই 


কলরবে ভরে থাকা গাছপালা, সন্ধের রোয়াক 

খেউড়, শলাকা আর আগুন জ্বালিয়ে রাখা 

                                          সমাজের পরিখা পেরিয়ে 

দাঁড়াই দু'দণ্ড, দেখি প্রদাহে বিদীর্ণ এক দমবন্ধ বাড়ি আর 

ব্লটিং কাগজ হয়ে শুয়ে আছে জানালায় মন 


ভুল পূর্বাভাস ধরে খুঁজে ফিরি দগ্ধদাহ পেরিয়ে কোথায় 

লুকিয়ে রয়েছে বসে মুখচোরা, শ্যামবর্ণা বাইশে শ্রাবণ!


ঋণ

অর্ণব পণ্ডা

টুটা ফাটা মাটি আর 

খরায় দগ্ধ সব উদ্ভিদের প্রাণ।

তবু সে দাঁড়াল গিয়ে খেতের সীমায়।

মাথায় ফসলভার রাখতে পারে না, তাই

দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়ল ঋণগ্রস্ত ডালে একদিন।

ঝুলে আছে কাকতাড়ুয়া, ঝোলা হাত, দেখছে সবাই।

দেখতে পায়নি কেউ, সেই একা লোক

ফসল বাঁচাবে বলে,

বাড়ি বাড়ি ফসল পাঠাবে বলে, মাথার ভেতর

সারাক্ষণ কাক আর বুলবুলি তাড়ায়...


ছোঁয়া

অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় 

সবটুকু অভিমান কেবল অপরাহ্ন খোঁজ রাখে

প্রেম ও ঈর্যা বুঝি কমলালেবুর দুটি কোয়া...

বাতাস দোলায় রঙ...অসুখ ডাকছে জোরে কাকে...

বিকেল এক্ষুনি এল...সেরেছে বিকেলের গা-ধোওয়া...


কমলা-আভা রূপ বদলে কিছু পরে পাশুটে-ধুসর...

ছাদের কার্নিশে ছায়া আপন হাত-পা মেলে দেবে...

যা বলার এখনই বলো— সে’ ও আলো যায়নি কেউ ঘর...

নাহলে যাবজ্জীবন কেটে যাবে শ্বাসবদ্ধ সেলে...


কমলালেবুর রেশ আর একটু শেষ দেখে যাবি?

হবে কি হবে না সারা বিকেলের পবিত্র সে-দাবি...!


জানোয়ারমশাই

সৌভিক গুহ সরকার

এখন পরীক্ষার খাতার পাশ থেকে মাঠ চলে গেছে পৌষের দিকে; বুড়ো চাঁদ শরীর টেনে দিগন্ত পেরোয়― শুক্লপক্ষের কথা জিজ্ঞেস করলে, চুপ করে বসে থাকে তালের শিয়রে―বানান ভুলে যাওয়া অধ‍্যাপকের মতো; এখন জলও তেমন পাত্তা দেয় না আর; অথচ একসময়ে কী হুলুস্থুলের রাজা ছিল সে, বানের দেশে; আজও পথে হাঁটা আছে, তবু হাঁটার ভেতরে পথ নেই; কোথাও যাওয়ার না থাকলে, কোথায় যাওয়া যায়? ভরা শস‍্যের মাঠ― আজ ইতিহাস: কৃষকের আত্মজীবনী ছড়িয়ে থাকে পুরনো শস‍্যের স্মৃতিতে― 

রেল লাইন ঢেকে আছে গুঁড়ো সাবানের মতো সাদা কাশের জঙ্গলে― ঐ বাতিল লাইনে চলাচল শেষ; স্টেশনও কাপড় কেচে চলে গেছে অন‍্য লোকালয়ে; ইদানীং, পুরনো চা ফুটিয়ে খেতে হয়―অল্প চুমুক দিলে মেজাজ কুঁচকে ওঠে― প্রদীপশিখা দপদপ করে―

অথচ, মিনসে কাঙাল ধুরন্ধর―এখনও তেমন আচমকা হরিণীর মুগ্ধ ইশারা পেলে―

গভীর রাতে― তার বিপর্যস্ত বলিরেখা ফাটিয়ে― ক্ষুৎকাতর হ‍্যাংলাচরণ জানোয়ারমশাই আসেন!


শতবর্ষে সুভাষ

সন্দীপন রায়

আঁকলো কি কেউ তোমার ছবি?

লিখলো কি কেউ পদ্য?

উদাসীন তুমি আগুন বুকে,

নিচ্ছো জন্ম সদ্য। 


জন্ম তোমার প্রত্যহ রোজ,

একশো বছর হাঁটছো।

ফুল ফোটানোর ফাগুন মাসে 

জীবন ভালোবাসছো।


মেঘ কখনো, বৃষ্টিও হয়,

তবুও ওঠে সূর্য রোজ।

চলবে সময় খেয়াল নিজের 

থাকবে তবু তোমার খোঁজ। 


দিন বদলের স্বপ্ন চোখে 

কলম হাতে করলে চাষ।

বাম দিকে পথ দৃপ্ত হেঁটে 

ঝলমলে রোদ নাম সুভাষ।


হাঙর 

চিরঞ্জিৎ সামন্ত

স্বপ্ন এসে মাথা খেল। কালনিদ্রা হাঙরের দাঁত

দ্বিখণ্ডিত চরাচর ভেসে যায় ভ্রমণস্মৃতিতে

ঘুমন্ত শিশুরা জাগে জাদুঘরে মোম জ্বলে দিতে

প্রত্নছায়াটির গায়ে রক্তপ্রবাহের ধারাপাত

বিরহ পুষেছি ফিরে, বন্ধুসম দিনপঞ্জিকাটি।

হলুদ ফ্যাকাশে দিন, সারিবদ্ধ কাকেদের শোকে

স্বপ্নটি ভূমিষ্ঠ হয়। সমুদ্রঝঞ্ঝার দাঁতে নখে

অতিকায় কালো ডানা নিয়ে ওড়ে জরাগ্রস্ত পাখি...


প্রলয়ের অভিকেন্দ্রে উপনীত সন্ত্রাসে দুজন

যে বুকে পাথর রাখা,যে নুড়ি গড়িয়ে পড়ে জলে

নুলিয়ারা ফিরে আসে, মৃত জলদানবের স্তন

ফুলে ওঠে।অগ্নিরেখা বিস্ফারিত খনিজ তরলে...


আশরীর ধরে থাকি কী পবিত্র হারানোর ভয়!

মাংস খসে খসে পড়ে ভেসে যায় অস্থি ও সময়...


শুক্তো ও ডাকঘর 

উজ্জ্বল ঘোষ 

বাতিল শুক্তোর তেঁতো ছুঁয়ে থাকো তুমি,

মেশাও ধৈর্যের গুঁড়ো, মনোযোগ দাও।

শুক্তোর অবলা চোখ, মুখ চেয়ে থাকে-

সে কথা ভালোই জানো ব’লে, আরও যত্নে

তাকে গড়ে তোলো দিনে দিনে। 

                            তাই দেখে

আমি ডাকঘর ছাদে নিয়ে যাই চোখের সম্বল

আকাশ তখন এক ফিলিপ্স রেডিও

আমার আঁধার আকাশবাণীর শ্রোতা

কলকাতা-ক তরঙ্গে চলে অনুরোধের আসর

অনুরোধ করে চিঠি আষাঢ় শ্রাবণ 


তরুণ অশান্ত কে বিরহী, দুখু মিয়াঁ? 


চাঁদনি কেদারে বর্ষা নামে শুনি হৈমন্তী শুক্লায়...


বহুদূরের বন্ধুকে

জুঁই রায় 

জানলা খোলা ... চাঁদের গায়ে মেঘ 

আস্তে-ধীরে রাশ টেনেছে ভোর 

হৃদয় পোড়ে, গায়ে দারুণ জ্বর 

স্বপ্নকবি, নাম কী ছিল তোর? 


কেমন ওঠে, আবার নামে চাঁদ 

রাত গড়িয়ে আকাশপারে ঢেউ 

স্বপ্নে কত প্রেম-পরাগী ভিড় 

স্বপ্নকবি, চাইছে তোকে কেউ 


ক্লান্ত পাখি ভীষণ শীতে কাত 

একলা রাতে খুঁজছে বুঝি ওম 

রাতের সাথে বাড়তে থাকে তাপ 

বহ্নিবিনা গলছে তবু মোম 


রাতদুপুরে দস্যি বায়ু বয় 

অনেকখানি আগের কথা, মুখ ...

জানলা খুলে অপেক্ষাতে রোজ 

স্বপ্নকবি, সেই তো ভারি সুখ 


লুকোনো সেই অনুভূতির ভাঁজ 

পুড়িয়ে রাত আনছে রোজই ভোর 

সুবাসী এই আখর জুড়ে তুই 

স্বপ্নকবি, নাম যেন কী তোর?


অবলুপ্তি

সৌমাল্য গরাই

গভীর সমুদ্র ডুব দিচ্ছে নিজের ভেতর। একটা আয়না মুখ ভেসে উঠল, প্রার্থনা ও মন্থন সমূহ উড়ে গেল দিকচক্রবালে। দূরে ঘূর্ণিফেরত জাহাজ ভাঙা মাস্তুলে  নিশানা দিচ্ছে।  ধাতব মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় বিষধর সর্প, তাদের অজ্ঞাত ডিম ফুটে জলমিথুনের সময় ঘনালো। জানি এসময় নিষাদ আসবে ক্রৌঞ্চবিরহের তির হয়ে। ধীরে ধীরে তার চোখ সরে যাবে নিজ অবস্থান থেকে।  এমন ঘোরের পাশে দেখব স্বয়ং আমি কুঁকড়ে গিয়েছি —সম্পূর্ণ সমুদ্র, সম্পূর্ণ জাহাজ অথবা মানুষ না হতে পেরে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছি বায়ুতে, অগ্নিতে, বিলুপ্তিতে...


আপন মায়ার চোখ

সোহম চক্রবর্তী

মধুর মুরলী বাজে কদম্বের বনে। দিকে দিকে সমাসন্ন শাঙন গগন। ওড়ে মেঘ পর্বতমেখলা থেকে দূর। ঝিরিঝিরি জলে মিঞা মল্লার বাঁধেন। হৃদিপদ্মে কেঁপে ওঠে প্রত্নপদাবলী। সুর – শুধু সুর চলে এ-পথে ও-পথে। ফকিরের গলা হয়ে বোষ্টমীর ঘাট, কিশোরের ঋজু ছায়া দুলে-ওঠা মাঠ – ছুঁয়ে আসে সুর – খেলা করে সুর গানে। টুপটাপ টুপটাপ ঝরে সেই গান। সেই গান কাগজের নৌকা হয়ে যায়। ভেসে যায় ভেসে যায় পাড়া থেকে পাড়া। শিরশিরে হাওয়া এক মায়ার মতোন – বিগতবয়সী চোখে বেদনাসম্ভব – ঘরে ঘুম-ভাঙানিয়া ঢেউ দিয়ে যায়। আঙিনাতে ঘনশ্যাম আঁধার করেছে। কাজল দীঘিটি নীল জলে হাবুডুবু। উদাসী রাখাল এক লোকমুখে ফেরে। আলের ধারেতে সে-ই দাঁড়িয়েছে একা। হরিণীর কালো আঁখি প্রবাদে করুণ। অথচ আগুন ছিল শ্রাবণের মোহে। রিনিকিঝিনিকি তালে চকিত বিদ্যুৎ। ছাদে ছাদে অশ্বারোহী দুরন্ত সওয়ার। এ সজল দস্যুদল প্রদীপ নেভায়। শ্যামল রাত্রির দ্রোহ বুকে হামাগুড়ি। মৃদু আলো, ভাঙা চাঁদ তিরতির কাঁপে। মেঘে মেঘে মাখামাখি জ্যোৎস্নার রস। ভাসানের ভেলা ভাসে স্রোতে উজানিয়া। মোহন যামিনী জল যমুনায় স্থির। অভিসারে যাবে আজ মানিনী রাধিকা? কুমকুম, যূথীগন্ধ, অগুরু-চন্দন – বরমাল্য বুকে তার তিয়াসায় দোলে। দিগন্তপিয়াসী মেঘ, যক্ষপুরে যাও – ছুঁয়ে থাকো করাঙ্গুলি প্রিয়ার কপোলে। ছুঁয়ে থাকো, সুর – খেলা করো, সুর – গানে। সেই গান বেদনায় ছড় টেনে যাক। ভেসে যাক শালপুঁথি, বিরহলিপিকা। আমি একা কথাকার, আদিম বালক – বরষা মানেই মায়া আখরে বেঁধেছি...

সব ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি বারবার। লাল-নীল ইশকুলবাড়ি, রোদ ও বিষাদে ভেজা জলাঙ্গীর জল – সবকিছু ছেড়ে। একেবারে চ’লে যাওয়ার আগে শেষ একবার ঘর গুছিয়ে নেওয়া কাজ। ঝাঁপ দেওয়ার আগমুহূর্তে শেষ একবার পিছনে তাকানো চিতাবাঘের চোখটি যেমন আত্মহত্যাকারী। কোণাকাঞ্চির ধুলো ঝাড়তে গিয়ে খুঁজে পাওয়া কবেকার পুরোনো বোতাম, ট্রেনের টিকিট, পেনের ঢাকনা আর ছলকে পড়া চায়ের দাগ। এইটুকু ফেলে যাওয়াকেই চিরকাল বিচ্ছেদ ব’লে এসেছে মানুষ। তারপর শ্বাস টেনে পাল্টে ফেলেছে ঠিকানা, বসতভিটে। বদলে নিয়েছে দেশ। কী যেন রইল পিছে – এই প্রশ্নের উল্টোদিকে নাকবরাবর দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতি, তোমাকে দশ গুণতে ব’লে কাদের যেন হারিয়ে যাওয়া দূরে। সব ছেড়ে চ’লে যাচ্ছি। আগল পরখ করছি খিড়কিদুয়োরে। মায়াদের হাত ধ’রে বুঝিয়ে দিচ্ছি হিসেবনিকেশ। এরপরে আর ফিরে দেখতে নেই। তবু এই আঙিনা আঁধার-করা মেঘ ফিরে ফিরে আসছে কড়ি মা-য় – পিছু ডাকছে – মা-এর দুঃখ থেকে আমি আর এক পা-ও এগোতে পারছি না...

আসলে তুমিও জানতে, ঘোলাটে সন্ধে মানে মেঘে মেঘে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসজল – চারিদিকে শুধু এক সোহাগী সবুজ, আর আমি স্রেফ তোমার ভিতরে এলোমেলো আটকে পড়েছি। এইটুকু ভেবে শুধু খচখচ করে, আপন মায়ার চোখ এমন এক চক্রব্যূহ, জাল – যেখানে আটক ঋতু উড়ানের মিথ্যে হিসেব, অথচ তুমিও মাঝেমধ্যে পাখিজন্ম চাও...


মধ্য রাতের জীবনী

প্রীতম বসাক  

মাঝরাতে ঈশ্বরের কাছে আগুন ধার করি । চেখে দেখি পাহাড়ের আত্মকথা। শক্ত অন্ধকার ভেঙে পাখি উড়ে যায়। প্রতিটি বাক্যে সরলতা জ্বলে নেভে। ঈশ্বর শোনান বিষের সংজ্ঞা। আমি তাকে কাব্যের জ্যামিতি শেখাই। বলি ঘাম থেকেই যে কোন সন্তানের জন্ম। ওম দিয়ে ফসলের চোখ নরম করতে হয়। পথ জুড়ে জন্মের প্রেত ডাকে। অতঃপর  ঈশ্বর কবিতা লিখতে ওজু করেন। আর আমি বিষ মাখি চুলে। সব অক্ষর জ্যোতির্ময় হয়। সকল আমি গরল হয়ে জেগে থাকি।


মাথুর

অমিতকুমার বিশ্বাস

সমস্ত দিন মেঘের উপরে  

আহত ডানায় ভেসে-ভেসে তোমায় দেখি।

উড়তে থাকা  ওড়নায়  তুমি অভিমান বিঁধে 

স্বামীর পাতে ঢেলে দাও রোজ অনিচ্ছুক সুধা।

 

তোমার ঘর-গেরস্থালির

বাইরেই এক নির্জন চাঁপা গাছ। ওর ডালে অপেক্ষার জীবাশ্ম জমতে -জমতে ফুরিয়ে আসে আকাশগঙ্গার আয়ু । 


তোমারও কফির কাপে মিশে যায় সন্ধ্যের গুড়ো-গুড়ো অন্ধকার, দূরবর্তী তারার মৃদু আঁচ।

Post a Comment

0 Comments