পুজোর গল্প : অপেক্ষা


অপেক্ষা

আবীর মুখোপাধ্যায়

সে দিনও মেঘ। সঙ্গে হুহু হাওয়া। 

দরজা-জানলার পর্দা সেই মৌসুমী হাওয়ায় ফুলে ফুলে উঠছে। এ বাড়ি-ও বাড়ি থেকে ভেসে আসছে মোহর-দেবব্রত। 

‘‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে/ তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে/ সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে’’, ‘‘শ্যামল ছায়া, নাইবা গেলে/ শেষ বরষার ধারা ঢেলে/ সময় যদি ফুরিয়ে থাকে—  হেসে বিদায় করো তাকে,/ এবার নাহয় কাটুক বেলা অসময়ের খেলা খেলে...।’’

দেবেশের সঙ্গে আজ প্রথম দেখা হবে পরমার। 

তিনমাসের ফেসবুক, মেসেঞ্জারে আলাপ-বিস্তার। লেন-দেন। নিধুবাবু-বেগম আখতার, বিনোদবিহারী-মকবুল, ঋত্বিক-সত্যজিৎ, শিলং পাহাড়-কক্সবাজার। 

সাইবার শিকল ভেঙে মুখোমুখি এই প্রথম।

রোজের কাজ করে মলিনা চলে যাবার পর, পরমা এখন সারা বাড়ি ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে। আসলে ও খুব পারফেকশনিস্ট। রবীন্দ্রনাথের বাল্মিকী প্রতিভার ছবিটা একটু ডান দিকে হেলে আছে যেন, সিডিগুলো কি একটু উলঢাল? বেডকভারের কোনটা ঈষৎ কোঁচকানো মনে হচ্ছে, এহে... ডাইনিং টেবিলে ফুলগুলো শুকনো লাগছে— এসব টেনেটুনে, ঠেলেঠুলে ঠিক করতে করতে, ফুল তুলতে তুলতেই ভাবছিল একটু আগে দেবেশের সঙ্গে হোয়্যাটসঅ্যাপের কথা।

‘‘...তোমাকে দেখবার জন্য সকাল থেকেই ছুটছি!’’

‘‘কি এত দেখবে আমাকে? দুটো হাত, দুটো পা, পাশ বালিশের মতো ধর আর টেকো গর্দান!’’

‘‘ঈশ্‌...!’’

‘‘সত্যি বলছি।’’

‘‘থাক। আমি বুঝে নেব।’’

‘‘তুমি তো রাজি হলে না। কখনও ভিডিও কলে এলে না। যতোবার চেয়েছি, এড়িয়ে গেছ। অথচ— প্রোফাইলে ওয়াহিদা রহমানের ছবি!’’

‘‘সামনা-সামনি দেখো।’’ 

‘‘সে না হয় হল, তবে নিজের মতো একটা ক্যানভাস এঁকেছি। কেবল ডিটেলিংগুলো মিলিয়ে নেব হয়তো।’’

‘‘যদি না মেলে?’’

‘‘জল রঙে আঁকা— তাছাড়া সকাল থেকে মেঘ। আশা করি, দুপুরে যে সময় শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস নামিয়ে দেবে আমাকে বোলপুরে, তখনও মেঘ-বৃষ্টি থাকবে। বৃষ্টির জলে রং ধুয়ে নতুন করে এঁকে নেব আবার!’’

‘‘চিত্রকর আমাকে ক্যানভাসে ধরতে মরিয়া দেখছি!... কি খাবে দুপুরে? জুঁইফুলি ভাত, বাটি পোস্ত, মৌরলা মাছ ভাজা আর সরষে ইলিশ— এতে কি হবে?’’

‘‘হবে মানে? কতকাল বাটি পোস্ত খাইনি! আহা...!’’

‘‘আচ্ছা শোনও, ঠিকানা মনে আছে তো? শ্রীপল্লি।’’

‘‘শান্তিদেব ঘোষের বাড়ি চিনি। কিছু গানও শুনেছি— ‘‘সব দিবি কে, সব দিবি পায়, আয় আয় আয়।’’

‘‘স্বর্ণরথ না পেলেও স্টেশনে টোটো পাবে। লালবাড়ির কাছে— মনে থাকে যেন!’’


  দেবেশের সঙ্গে কথপোকথনের কথা ভাবতে ভাবতে পরমা কখন যে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে— ও নিজেই জানে না। কোমরে, তলপেটে আলতো মেদ জমেছে। মুখের গড়ন বদলেছে অনেকটা। তবু নিজেকে সুন্দর রেখেছে ও। বাদল হাওয়ায় চিবুকে এসে পড়েছে ছন্নছাড়া চুলের গুছি। পাশ থেকে ঠিক কলেজবেলার  পারো যেন। 

কে বলবে গত ফাল্গুনে চল্লিশ পেরিয়েছে। 

এতটা পথ একা থেকেও, জীবনযুদ্ধে কখনও হারেনি ও। 

কলেজবেলার প্রেম থেকে বিয়ে-সংসার সেই কবেই ফুরিয়েছে। এক শহর থেকে আরেক শহর। ছেলে-মেয়ে এখন বিদেশে। ও আবারও একা।  

কোন শাড়িটা পরবে আজ? 

এগারোটা বাজতে গেল— এখনও কিছুই ঠিক হয়নি! সে কথা মনে পড়তেই দৌড়ে ঘরে গেল পরমা। ওয়ার্ডরোব খুলে একটার পর আরেকটা শাড়ি বুকে ফেলে আয়নায় দেখতে লাগল। 

তার শাড়ির সংগ্রহ দেখে অনেকেই হিংসে করে। তবু আজ সব শাড়িই বেমানান মনে হচ্ছে পরমার। হঠাৎ বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলায় পিসিমার উপহার দেওয়া লাল বেগমফুলি শাড়িটার দিকে চোখ গেল। ধক করে উঠল বুকটা। বুকে ফেলে দেখেই হেসে ফেলল নিজে! 

মনে মনে বলল, বহুদিন পর একটা পুরুষ মানুষের সঙ্গে দেখা হবে বলে কি যে করছে— আসলে দীর্ঘ, সুদীর্ঘ সময়, একা একা জীবন বয়ে আজ বেশ ক্লান্ত পরমা। ডিভোর্সের পর নির্মলের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ নেই। ঋজুল-মৌমন চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে যাওয়ার পর এই দেশে আত্মীয় বলতে কেউ নেই তার! 

তার খুব ইচ্ছে করে... ইচ্ছে করে শক্ত— চওড়া একটা বুকের মধ্যে নিরাপদে ঘুমাতে! মুখোমুখি বসে দিনভর কথা বলতে, নির্ভর করতে। 


শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস বোলপুরের দিকে চলে গেছে বহুক্ষণ। 

বনপাস স্টেশনে স্লো হতেই কেন যে নেমে পড়ল দেবেশ! আসলে, তার খুব ইচ্ছে করছিল ধানখেতের মধ্যে দিয়ে দূরের গ্রামে হেঁটে যেতে। সুলগ্নার সঙ্গে ঝগড়া করেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে সে। আসলে, এভাবে আর চলছিল না। তার মনে হচ্ছিল, সে কোথাও আটকা পড়ে যাচ্ছে। দেড় বছরে একটাও ক্যানভাস সে শেষ করতে পারেনি। বইপাড়ার কোনও প্রচ্ছদে তার নাম নেই! ক্রমে ফুরিয়ে যাচ্ছে সে!

দেবেশের ভাল লাগছিল নির্জন এই স্টেশনে নেমে। এর আগে সে যতবার শান্তিনিকেতন এসেছে, জানলা দিয়ে এইসব নিরিবিলি স্টেশন দেখে ভেবেছে, কখনও নেমে পড়বে একা। নিজের মতো সময় কাটাবে গোটা একটা দিন । আজ ঠিক তেমন একটা দিন। একটা রাধাচূড়া গাছের নীচে বেঞ্চে ব্যাগটা রেখে আরাম করে বসল ও। দূরে তাকিয়ে ভাবছিল সুলগ্নার কথা। ঠিক তখনই ফোনটা এল—

‘‘যাবার আগে একটিবার বলে গেলে না?’’

‘‘বলতাম। আসলে, তোমরা ঘুমিয়েছিলে!... বিরক্ত করতে চাইনি আর!’’

‘‘আমি তোমার স্ত্রী দেবেশ! দশ বছরের প্রেম আর সাড়ে চার বছরের সংসার! পিকলুর কথা মনে পড়ল না একবার? তুমি তো জানো, ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখলে, কেমনভাবে কান্নাকাটি করে ও!’’

‘‘আমি আর পারছিলাম না সুলগ্না। আমি ক্লান্ত। অনেক ভেবে দেখলাম। এভাবে থাকা যায় না। জানি না, পারব কিনা! আপাতত আর না। তাই তোমাদের না জানিয়ে বেরিয়ে এসেছি পথে। আমাকে...।’’

‘‘কোথায় তুমি?’’

‘‘জায়গাটার নাম গোপন রাখছি।’’

‘‘সঙ্গে কে? কার সঙ্গে পালিয়েছ? সেই মডেল! যে তোমার সব ছবি কিনতে চেয়েছিল!’’

‘‘নতুন করে পালাবার মতো কাউকে পাইনি সুলগ্না। কারও সঙ্গে শেষবার পালিয়েছিলাম সাড়ে চার বছর আগে, ৪ ফেব্রুয়ারি। খড়গপুর লোকাল ধরে, সেই প্রথম তোমার সঙ্গে ঘর করব বলে ভোর ভোর বাড়ি ছাড়া। সুতরাং...। ভাল থেক, আমাদের দু’জনেরই নিজেকে সময় দেওয়া দরকার।’’

‘‘এখন তোমার এসব মনে হচ্ছে? এভাবে পালালে কেন?’’

‘‘বলতে পারো, নিজেকে সময় দিতে একটু একা হয়েছি। নিজেকে ফিরে পেতেই হবে। তুমি তো জানো— একটাও ছবি আঁকতে পারছি না মাসের পর মাস ধরে। এভাবে...।’’

‘‘তুমি তাহলে...!’’

‘‘প্লিজ একটু... কয়েকটা দিন। জানি না— কতো দিন!’’


লাইনটা কেটে গেল। অনতিপর কয়েকটা রিং হয়ে হয়ে থেমে গেল। 

দেবেশ শুনতে পাচ্ছিল ওপারে সুলগ্নার কান্নার শব্দ। পিকলুর কথা ভেবে ওর চোখের কোণ ভিজে আসে। জন্ম থেকে পিকলুর জগৎ দেবেশ। ছেলেটা কীভাবে থাকবে একা একা এখন! কে খাইয়ে দেবে, দুপুরবেলা গল্প শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়াবে।

দেবেশ ভাবছিল, সে না থাকলে কি কি অসুবিধেয় পড়বে সুলগ্ন। মাইগ্রেন নিয়ে রোদের মধ্যে একা একা সব করতে হবে! খারাপ লাগছিল। কিন্তু কিছুতেই ফিরে যেতে যে মন সায় দিচ্ছে না তার। মনে পড়ে যাচ্ছে, হররোজ হেরে যাওয়া!

বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছে দু’তরফেই! ভাঙা দেশ জোড়া লাগে, কিন্তু বিশ্বাস? ফেরে না কখনও! ফিরলেও গোপনে গোপনে ক্ষয় চলে নিত্য!


হাওড়া মুখি একটা লোকাল ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে।  

গার্ডের বাঁশির শব্দে খেয়াল হল দেবেশের। কিন্তু ও ফিরবে না। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ ঘুরিয়ে নিল দূরে, দূর দিগন্তে গাঁ-ঘরের দিকে। দুপুর গড়াচ্ছে। দেবেশের নিজেকে নিজেকে নিষ্ঠুর মনে হচ্ছিল। তবু না। 

উঠে পড়ল সে। হাঁটতে শুরু করল। 

এখন সে কোথায় যাবে— পরমার কাছে?

দেবেশ নিজেও জানে না। রেললাইন ছেড়ে সে মাঠের মধ্যে দিয়ে আলপথে নেমে আসে। ধানজমি, বন-বাদাড়, পুকুরঘাট-নদী-বাঁধ পেরিয়ে সে বোলপুরের দিকে হাঁটছে। বৃষ্টির পর মেঠো গন্ধে মাতাল সে। 

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। বিকেল—সন্ধে, রাত। 

তার কোনও তাড়া নেই। কোথাও কোনও সুস্থির গন্তব্যও নেই। জীবনকে নতুন করে ফিরে পেতে চায় সে। তাই হাঁটছে। নিজেকে আরেকবার আবিস্কার করতে চায়! তাই হাঁটছে!

দেবেশ বুঝতে পারে, এই ঠিকানাবিহীন যাত্রা আসলে তার অপেক্ষা!


বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে। এ পাড়ায় ঢের বৃষ্টি হয়ে গেল একটু আগেও। 

বাতাসে বৃষ্টির সুবাস। গেটের কাছে ভিজে কাগজফুল একরাশ। 

বেগমফুলি শাড়িটার পেটে জলভরা বাতাস ফুলে ফুলে উঠছে। পরমা তাকে সামলেসুমলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। 

দূর আকাশে একটি-দুটি সন্ধ্যাতারা। সে জানে, দেবেশ ঠিক ওই তারা দেখে বাড়ি চিনে নেবে। একদিন চিনে নেবে!

আজকাল অপেক্ষা করতে তার ভাল লাগে!



Post a Comment

0 Comments