এ বার পুজো রান্নাশালে


এ বার পুজো রান্নাশালে

মৌমন মিত্র

এ বছর নিউ জার্সির ঐতিহ্য পুজোয় ভাঁটা পড়ল। মার্কিন দেশের প্রায় সর্বত্র এবার পুজো, নেট পুজো। দর্শনার্থীরা সময়সীমা ধরে মন্দিরে মায়ের দর্শন করতে পারবেন ঠিকই তবে সঙ্গে থাকবে স্যানিটাইজার, মুখোশ, দৈহিক দূরত্ব। প্রতি বছরের সেই হুল্লোড়, উল্লাস আমরা স্থগিত রাখলাম। তাই অনলাইন অন্যরকম পুজোর দিনে বাড়িতে বসেই বারো হাতের সাজকথা। ড্রেপিং, স্টাইলিং, কোমরে আঁচল গুঁজে আয়নার সামনে সুপ্ত ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ। সঙ্গে আমার পঞ্চব্যাঞ্জনের জমাটি আয়োজন। 

পুজোর আর বেশিদিন বাকি নেই। রেস্ট্রিক্টেড জীবনে, আমার হেঁশেলের মিল প্ল্যানিং শুরু হয়ে গেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে আমার ঢাকাই, লিনেন বা শান্তিপুরীর জল্পনা। মনে নানা সাধ, সেই সঙ্গে আশঙ্কাও। সব ঝেড়ে ফেলে বাঙালির মন সেজে উঠুক। উৎসবের এই তো ক’টা দিন! এ বছর রেস্তোরাঁর নৈশাহার বাতিল করলাম। পুজোর চারদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখব অনলাইন পুজো দেখে, চিরচেনা সনাতনী পোশাকে এবং অবশ্যই আমার পরিবারের জন্য থাকবে ঘরোয়া ভূরিভোজের আয়োজন। 

যুযুধান প্রতিপক্ষ নয়, মাছ মাংসের কিন্তু গলায় গলায় মিলমিশ। সকলের পুজো জমিয়ে তুলতে সুদূর আমেরিকা থেকে মাছ, মাংস, মিষ্টির এক গুচ্ছ রেসিপি উপহার দিলাম এখানে। বাড়িতেই নাহয় এ ক'টা দিন চামচ, কাঁটাচামচ, ন্যাপকিন সহকারে বেশ রেস্তোরাঁ রেস্তোরাঁ একটা পরিবেশ তৈরি করি। 

সপ্তমী : এ দিন আমি মধ্যপ্রদেশের ট্রাডিশানাল তসর পরব। পাড়ে রেশম সুতোর কাজ। গয়নায় বিডস, পুঁতি। এর পাশাপাশি উৎসবের প্রথম দিন ইলিশবিলাসে মন ভোরে উঠুক।

আমি ইলিশ কিনি আমার নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি এক ডাকভাই এর কাছ থেকে। প্রত্যেকবার ও আমায় সুস্বাদু ইলিশ দিয়েছেন। এই দেশে ইলিশ আসে পদ্মার থেকে। মায়ের বিসর্জনের সঙ্গেসঙ্গে বাংলার বহু পরিবারে হেঁশেলে ইলিশ রাঁধা বন্ধ হয়ে যায়। তাই দশমীর আগে ভাপা ইলিশ মেনুতে থাকা চাই-ই-চাই! 

এই সপ্তমীতে রেঁধে ফেলুন সুগন্ধী ভাপা ইলিশ। দই, ক্রিম, লঙ্কাবাটা, কাজু- পোস্তবাটা, দুধে ভেজানো কেশর, গোলাপজল সব এক সঙ্গে ভাল করে মিশিয়ে নিন। এবার মাছ ধুয়ে নুন মাখিয়ে এই মিশ্রণ মাখিয়ে নিন। ট্রাডিশানাল ভাবে টিফিনবক্সে মিনিট ২০ ভাপিয়ে নিতে পারেন অথবা ইন্সটা পটের  স্টিম সেটিং দিয়ে  ৫ থেকে ৮ মিনিট ভাপিয়ে নিয়ে পারেন। গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন। 

শেষ পাতে মিষ্টি দই স্যুফলে হলে অমৃত সম সুখাদ্য।মিষ্টি দই, জেলিং এজেন্ট এবং ক্রিম একসঙ্গে মিশিয়ে নিন।ছোট র‍্যামকিনে প্রথমে স্পাঞ্জ কেক, তার উপর ক্যারামেল সস, তার উপর দই এবং ক্রিমের মিশ্রণ দিন। জিনিসটা ফ্রিজে জমতে দিন। সার্ভ করার সময় গ্রেটেড পাটালি গুড় দিয়ে সাজিয়ে দিতে পারেন। 

অষ্টমী : পুত্র কন্যা এ দিন অঞ্জলি মিস করবে। ওরা জানে এই বছর শিউলি, পদ্ম দেখতে পাবে না। করতলে অঞ্জলির ফুল নেবে না। তবু হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল দু'জন। কালার কোঅরডিনেট করে ফুশিয়া অ্যাসিমেট্রিকাল লং ড্রেস আর সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরবে দু'জন। পুত্র পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করে ডেনিমের সঙ্গে। লাজুক ছেলে ক্যামেরা অন হলেই আড়ালে মায়ের হাজার বুটি ঢাকাই আঁচল ছুঁয়ে। কন্যার পছন্দ মায়ের খোঁপার সুগন্ধী ফুল এবং সাশার নেকপিস। 

এ দিন মেনুতে মিষ্টি পোলাও, কুন্দন কালিয়া।

কুন্দন কালিয়া করতে কড়াইতে তেল গরম করে, ভেটকির কিংবা যে কোনো সি-ফিশ ফিলে নুন-হলুদ মাখিয়ে ভেজে নিন। পুরের জন্য কুচোনো পেঁয়াজ, আদা রসুন বাটা ধনেগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, সরষের তেলে কসিয়ে, মাছে গা মাখা করে মিশিয়ে রাখুন। অন্য পাত্রে মাংস সেদ্ধ করে স্টক রেখে দিন। মাংসের টুকরো চিরে তার মধ্যে মাছের মিশ্রণ দিন। মাংসের মুখ বুজিয়ে বল করে ঘি বা তেলে ভেজে রাখুন। আলাদা কড়াই এর মধ্যে চিরাচরিত কালিয়ে তৈরি করে, তাতে মাংস ও কিছুটা স্টক দিয়ে ফোটান। ফুটে উঠলে কেওড়া জল ও জাফরণ দিয়ে পরিবেশন করুন। তবক দিয়ে সাজিয়ে দিতে পারেন।     

নবমী : এখন রকমারি নানা কুইজিনের উপকরণ কেনা প্রায় সব বাড়িতেই বন্ধ। তবে এই দেশে যে কোনো বাঙালি বাড়িতে একটু মুরগি, মাছ, মাংস থেকেই যায়। মহামারির শুরুর দিকে অবশ্য সেটাও বন্ধ ছিল।

নবমী মানে উৎসবের প্রায় শেষ দিক। স্ক্রিনে সন্ধি পুজো দেখেই মন কেমন করা শুরু হয়ে গেছে। এ দিন ওয়ান ডিশ মিল আদলে কোরিয়ান ল্যাম্ব চপ তৈরি করতে পারেন।

প্রথমে ল্যাম্ব ভাল করে ধুয়ে একটি পাত্রে রাখুন। এই পাত্রে আদার রস, রসুনের রস লেবুর রস, এবং নুন দিয়ে ভাল করে ম্যারিনেট করে কিছুক্ষণ রেখে দিন। এরপর ম্যারিনেট করা ল্যাম্ব অল্প আঁচে আভেনে গ্রিল করুণ। মাংস নরম না-হওয়াপর্যন্ত গ্রিল করতে থাকুন। নরম হলে নামিয়ে নিন। এবার সস তৈরি করার জন্য একটি কড়াইতে তেল গরম করুন। এঁটে কুচোনো রসুন, ব্রাউন শুগার, ডার্ক সওয়া সস, ভিনিগার এবং রাইস ওয়াইন, ভিনিগার দিন। ভাল করে নেড়ে, ঘন হয়ে এলে বুঝবেন সস তৈরি। এবার গ্রিল কড়া ল্যাম্ব সসের মধ্যে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে নামিয়ে নিন। সারভিং প্লেটে ল্যাম্ব ঢেলে উপরে সামান্য তিল ছড়িয়ে দিন। গরম গরম পরিবেশন করুন। ফেসবুক লাইভ দেখতে দেখতে কোরিয়ান ল্যাম্ব চপ মন্দ লাগবে না। 

দশমী : যে-কোনও উৎসবের গোড়াতেই নিশ্চিত করা হয় তাঁর উপস্থিতি! অর্থাৎ তিনি না-থাকলে, কোনও অনুষ্ঠান, শুভদিন যেন সম্পূর্ণ হয় না। ছানার নরম তুলতুলে আস্তরণে গুড় বা চিনির প্রলেপ। আর সেই বস্তু মুখের মধ্যে মিলিয়ে যেতেই এমন সুখ! দশমীর দিনটির জন্য রইল মিষ্টি দই রসমালাই।  

রসগোল্লার রস চিপে নিন। মিষ্টি দই ফেটিয়ে ঘোল বানান। ঘোলের মধ্যে রসগোল্লা দিয়ে ফ্রিজে দুঘণ্টা মতো ঠাণ্ডা হতে দিন। এতে রসগোল্লার ভিতরে দই ঢুকে যাবে। পেস্তা দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

পুজো সবার ভাল কাটুক। মনের উল্লাস চাপা থাকবে জানি।তবু সবাই সুস্থ থাকুন। উৎসব মানে আনন্দ। আনন্দ মানে জীবন।জীবন থাকলে আনন্দ থাকবে। তাই এই বছরটা একটু সমঝে, সকলে দায়িত্বশীল হ’য়ে, আসছে বছরের জন্য অপেক্ষা করি। স্ক্রিন পুজো দেখে আর ঘরে ভাল মন্দ আহার আয়োজন করে এভাবেই বেঁচে থাক, মহামারির মাঝে আমাদের বেঁচে থাকা লড়াইয়ের দিনরাত্রি।     

Post a Comment

0 Comments