সুকুমার দাস
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা বহু পারিবারিক পুজোমণ্ডপ আজও মানুষের মিলনক্ষেত্র রূপে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ লাভ করে চলেছে।
সেই স্রোতের গতিতে সুরুলের দুর্গাপুজোয় প্রায় দশটি সাবেকি পরিবার আজ আরও বেশি উদ্যোগ আর মহিমা নিয়ে ধারিত। এতগুলো সুপ্রাচীন পুজোর একত্র সমাবেশ সত্যিই অন্য কোনও গ্রামের তুলনায় এক বিরল নিদর্শন। যে কারণে বীরভূম তথা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে সুরুলের দুর্গাপুজো এক বিশেষ গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত। যদিও এই গৌরবের নেপথ্যে সুরুলের দুই সরকার বাড়ির ভূমিকা অনন্য। তবে অন্য পুজোগুলোর ক্ষেত্রে ছোট ছোট ইতিহাস রয়েছে- যা সেভাবে আলোকিত হয় না। সাম্প্রতিক সুরুলে পারিবারিক ঐতিহ্যের পুজো মোট এগারোটি। সময়ের স্রোতে বিশেষ প্রয়োজন অনুভূত হলে অন্য চারটি পাড়ায় আরও চারটি বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজো যুক্ত হয়ে এখন সর্বমোট পনেরোটি দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। পূজোর সূচি-নির্ঘণ্ট নিয়মনীতি, রীতি, প্রথা তথা সাবেকিয়ানা মোটামুটি ভাবে কমবেশি প্রায় একইরকমের। পারিবারিক পুজোর ঐতিহ্যের অনুবর্তী হয়ে অন্যান্য সর্বজনীন পুজোগুলোও চলার চেষ্টা করে। যেমন প্রত্যেকটি পুজোর ঢোল, সানাই, কাঁসির সমাহার অন্যান্য গ্রাম-শহরের মতো এখানে কোনও পুজোতেই ঢাকের আওয়াজ পাওয়া যায় না। প্রতিমা-নির্মাণ ক্ষেত্রেও সাদৃশ্য রয়েছে। প্রতিবছর রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো করে মাটি ছোঁয়ানো, কাঠামোয় খড় বাঁধা ইত্যাদি। প্রথম দফায় মাটির প্রলেপ পড়লে তাকে বলে একমাটি, দ্বিতীয় দফায় তার নাম দুইমাটি, তারপর খড়ি বা সাদা রঙ এবং প্রতিমার মুখমণ্ডল, হাত-পায়ের গঠন তৈরি করে সাবুর আঠা লাগানো ইত্যাদি। পরবর্তী পর্যায় রঙের কাজ সম্পূর্ণ হলে ঘামতেল লাগানো। চতুর্থী-পঞ্চমীতে বস্ত্র-ধারণ, অস্ত্র ধারণ ও সাজ-অলংকার। সবশেষে চক্ষু-অঙ্কন। সাবেকি প্রতিমাগুলো সবই একচালার। অর্থাৎ দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গনেশ, কার্তিক, মহিষাসুর সবাইকে একত্রে একচালির মধ্যে সমান্বিত করা যেন আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের বহিঃপ্রকাশ। মাথার উপর লাগানো চালি পটশিল্পের নানা রঙের ছবিতে চিত্রিত। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ও অন্যান্য দেবদেবী বা লতা-পাতা-আলপনার ছবি- সবই হাতে আঁকা। মা দুর্গার মাথার উপর অবস্থান করেন মহেশ্বর। সব পুজোগুলোতেই দুর্গা- কমলা, লক্ষ্মী- হলুদ, সরস্বতী- সাদা এবং অসুর- সবুজ রঙের করা চাই। প্রায় সব মন্দিরেই ডাকের সাজ প্রচলিত।
শারদীয় এখন শান্তিনিকেতন এবারের সেরা শারদ সংকলন। সংগ্রহ করেছেন?
ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যেবেলায় দেবীর বোধন বা অধিবাস। মন্দির সংলগ্ন পুকুর থেকে ঘট আনা হয়। এরপর নবপত্রিকা অর্থাৎ নয়টি বৃক্ষকে একত্রে পুজো করা হয়। সপ্তমীর সকালে ঢোল বাজিয়ে চতুর্দোলা কাঁধে নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা করে নবপত্রিকা স্নান করাতে যাওয়া হয় গ্রামের বাইরে নতুনপুকুরে। ছোট বাড়ির ক্ষেত্রে তা পার্শ্ববর্তী ময়রাপুকুরে। যাই হোক, পারিবারিক ও অন্যান্য কয়েকটি বারোয়ারি পুজোর পালা করে করে নবপত্রিকা স্নানের বিষয়টি বেশ একটা দেখার মতো বিষয়। নবপত্রিকার মধ্যে যে গাছ বা পাতাগুলো থাকে সেগুলোকে একত্রিত করে হলুদ কাপড় জড়িয়ে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়, চতুর্দোলায় বসিয়ে ঢোল, কাঁসি বাজিয়ে পুকুরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ছাড়াও সন্ধিপুজোর সময় এবং দশমীর দিন বিসর্জনের আগে একবার করে আরতি অনুষ্ঠান হয়। সেই অর্থে দেখলে সমগ্র দুর্গাপুজোই এক অর্থে প্রকৃতিরই পুজো। কারণ প্রকৃতির সব উপাদানই এই পূজার এক একটি উপকরণ এবং সেই উপকরণগুলোকে পুজোর মাধ্যমে মান্যতা দেওয়া হয়। আরতির এক একটি ধাপে লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির স্নেহ-মায়া-মমতার নানা আবেগ। প্রসঙ্গত ঢেমুল, আরতি, বলিদান, বিসর্জন- নানা ক্ষেত্রে পৃথক বাজনার প্রচলন একটি লক্ষ্য করার মতো বিষয়।
বড়বাড়ি ঐতিহ্য, রীতি, প্রথা, সাবেকিয়ানা কিংবা বনেদিয়ানা- প্রায় সার্বিক দিক থেকে সুরুল সরকার জমিদার পরিবারের দুর্গাপুজো বীরভূম তথা বাংলায় এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। প্রাচীনতার বিচারেও বড়বাড়ির দুর্গাপুজো প্রায় তিন শতকের গরিমায় উজ্জ্বল। বহু দূর-দূরান্তের মানুষ বাংলা সংস্কৃতির নান্দনিক আভিজাত্যে এক অনুপম স্বাদ নিতে এখানে সামিল হয়ে ভিড় জমান। ড.বুদ্ধদেব আচার্য ‘বীরভূমের মুখ’ গ্রন্থের এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ব্রজবল্লভ সরকার ব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন এবং মৃন্ময় মন্দিরে দুর্গাপূজা প্রতিষ্ঠা করেন। ...এবং উত্তরকালে তাঁর তৃতীয় পুত্র শ্রীনিবাস সরকার এই মৃন্ময় মন্দির ভেঙে তার উপর পাকা ইমারত নির্মাণ করান। এতে খরচ হয়েছিল ১৮০০০(আঠারো হাজার) টাকা।’ সেখানে তিনি আরও বলেছেন যে শ্রীনিবাস সরকারই এই চকমিলান দালানে রাজকীয় মর্যাদায় দুর্গাপুজো শুরু করেন। যদিও অন্যত্র দুর্গাপুজোর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কৃষ্ণহরি সরকারকেই মনে করা হয় এবং সেক্ষেত্রে যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। এখন প্রতিষ্ঠাতা যিনিই হন না কেন আজ, সেই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে ‘চকমিলান দালান’ তৈরি হয়েছিল, পাশাপাশি ‘রাজকীয় মর্যাদা’য় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হওয়ার যে ঐতিহ্য ও গৌরব- একাধারে দুটি বিষয়ই সুরুলকে পর্যটন মানচিত্রে এক বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। সম্প্রতি ভিতরে প্রবেশ করে সবকিছু দেখার জন্য একটা সামান্য প্রবেশমূল্য ধার্য করা হয়েছে। এই ঐহিত্যবাহী মন্দির প্রাঙ্গণে ট্রাস্টের অনুমোদন নিয়ে বহু বাংলা, হিন্দি চলচ্চিত্র এবং সিরিয়ালের শুটিং হয়েছে, এখনও হয়ে চলেছে।
সপ্তমীর সকালে দোলা নিয়ে ফিরে আসার পর দালানের দোতলা থেকে সাধারণের মধ্যে নাড়ু ছড়ানোর ব্যাপারটি অভিনব যা আজ ও প্রচলিত আছে।
সাবেককাল থেকে এখানকার প্রতিমা একচালের। প্রতিমা নির্মাণে একটা সাবেকি ধাঁচ অনুসরণ করা হয়, সম্পূর্ণ হাতে তৈরি, কোনও ছাঁচের আশ্রয় নেওয়া হয় না। এমনকি রঙ ব্যবহারের মধ্যেও একটা সাবেকিয়ানা লক্ষণীয় বিষয়। চিরকালেই ডাব সাজের ব্যবহার একটি অন্যতম বিষয়। প্রসঙ্গত বড়বাড়ির দুর্গাপুজো একাধারে বৈষ্ণব ও শাক্ত উভয় মতে হয়। বর্তমানে তাঁদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুমানিক ৭০০। সপ্তমীর সকালে দোলা নিয়ে ফিরে আসার পর দালানের দোতলা থেকে সাধারণের মধ্যে হরিলুটের মতো নাড়ু ছড়ানোর ব্যাপারটি অভিনব, যা আজও প্রচলিত আছে। গ্রামের বহু ব্রাক্ষণ পরিবারে চিরচরিত প্রথানুযায়ী প্রসাদ পাঠানো হয়। প্রতিদিন পুজোয় প্রায় একশো থালা ভোগ নিবেদন করা হয়। বড় বড় কাঁসা ও রুপোর নির্মিত রেকাবীতে মায়ের ভোগ পরিবেশন করা হয়। আরতির সময় ঢোল-সানাইয়ের তালে তালে বড় বড় তালপাতার রঙিন পাখার ব্যবহার একটি অনির্বচনীয় দৃশ্য! এছাড়াও থামের গায়ে গায়ে, দেওয়াল জুড়ে চারপাশে রেরির তেলে জ্বালানো ঝাড়লণ্ঠনের আভিজাত্য এক নৈসর্গিক মন্ত্রমুগ্ধ পরিবেশ রচনা করে। দশমীর দিন সদস্যরা দুর্গামন্দিরে মিলিত হয়ে ‘যাত্রা’ অর্থাৎ মাকে বিদায়ী প্রণাম নিবেদন করেন। কুলদেবতা নারায়ন মন্দিরে সমবেত হয়ে অধীর আগ্রহে শঙ্খচিল দেখার অপেক্ষা করেন। কোনও সিঁদুর খেলার রীতি-রেওয়াজ এখানে নেই। এই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে একটি ছোট মেলা বসে। বড়বাড়ির এই দুর্গাপুজোর ইতিহাস এবার ২৯২ বছরের সাক্ষ্য বহন করবে।
ছোট বাড়ি: সুরুল সরকারদের ছোটতরফের চন্দ্রকুমার সরকারের স্ত্রী সারদাসুন্দরী দেবীর ইচ্ছা ও আদেশ অনুসারে, তাঁদের মধ্যমপুত্র দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে চন্দ্রকুমার-সারদার সাত সন্তান একযোগে তাঁদের দুর্গাপুজোর সূচনা করে। বিংশ শতকের শুরুর দিকে ১৩০৯ বঙ্গাব্দে প্রথম একটি মাটির চালাঘরে দুর্গাপুজোর সূত্রপাত। পরবর্তীতে দেবেন্দ্রনাথের সুপুত্র প্রণবেশ্বর সরকার, যিনি টোগো সরকার নামে অধিক খ্যাত, তাঁরই উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় বর্তমান পাকা মন্দিরে একচালা প্রতিমার দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। বিশেষ উল্লেখের অপেক্ষা থাকে যে, সৃষ্টিকালীন প্রাচীন রীতি-প্রথাকে সর্বাংশে মান্যতা দিয়ে, দেবেন্দ্রনাথ সরকার প্রণিত অর্পণনামা মেনে আজও প্রতিবছর যথাযথ মর্যাদায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁদের কুলপুরোহিত পুজো করে রথের দিন প্রথম কাঠামোয় গঙ্গামৃত্তিকা ছোঁয়ালে অনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপুজোর শুভ সূচনা হয় ও অন্যান্য কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে পুজোর কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুজোর উপাচার সংগ্রহ ও অন্যান্য কাজকর্ম শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসেন প্রতিমাশিল্পীরা। বংশ পরম্পরায় সুভাষ সূত্রধর প্রায় চারপুরুষ ধরে এই কাজকর্ম করে আসছেন। প্রতিমা মন্দির প্রাঙ্গণেই তৈরি হয়। মূল পর্বে পঞ্চমীর দিন থেকে ঢুলিদার, ময়রা, সাজের শিল্পী ও পরিচারক বা রাঁধুনীরা চলে আসেন। ষষ্ঠীর রাত্রিটি ছোট বাড়ির সদস্যদের কাছে বিশেষ গুরুত্বের ও আনন্দের। কারণ ঠাকুরকে গয়না, সাজসজ্জা, অস্ত্র প্রভৃতি দিয়ে সদস্যরা নিজের হাতে সাজিয়ে ভোররাত্রে বেদীতে তোলা হয়। সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নানের জন্য শোভাযাত্রা করে ময়রাপুকুর যাওয়া হয়। পুরুষানুক্রমে প্রায় তিন প্রজন্মের সদস্যদের একসঙ্গে উল্লাসিত নৃত্য এখানে একটি দেখার মতো বিষয়। এরপর পুজো শুরুর আগে যজ্ঞেশ্বর নারায়ন ও মা লক্ষ্মীকে মন্দিরে আনার বিধান। তাঁদের সামনেই নৈবেদ্য সাজানো হয়। কারণ কোনও ভুল ত্রুটি হলে যজ্ঞেশ্বর তাঁদেরকে নিজগুণে ক্ষমা করবেন- এরকম এক বিশ্বাস ছোট বাড়ির সদস্যদের মনে কাজ করে। মহাষ্টমীর দিন বাড়ির অধিকাংশ পুরুষ-মহিলারা উপবাস থাকেন। ১০৮ পদ্মে এই সন্ধিপুজো অনুষ্ঠিত হয় সেখানে ছাগবলির প্রথা আজও অটুট। নবমীর দিন হোম অনুষ্ঠানের জন্য যে মাটির বেদী নির্মিত হয়- তা ছোট বাড়ির ম্যানেজিং সেবাইতের হাতের মাপে। ওইদিন সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে এক ঘরোয়া নৃত্যানুষ্ঠানে মেতে ওঠেন। দশমীর সন্ধ্যায় প্রতিমা নিরঞ্জন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় মানুষের কাঁধে চড়ে চড়কপুকুরে। এরপর কালিসায়ের, শ্রীশ্রীশ্যামসুন্দর এবং লক্ষ্মীজনার্দন ও শিবমন্দিরে প্রণাম পর্ব সেরে সকলে দুর্গামন্দিরে সমবেত হন। যথাযত রীতি অনুযায়ী বিজয়া পর্ব শেষ করে সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফেরেন।
উত্তরপাড়ার মুখার্জী বাড়ি ‘চূড়ামনিদের দুর্গাপুজো’ বলে পরিচিত- যা সুরুলের প্রাচীনতম। কথিত আছে এই পুজো আনুমানিক চারশো বছরের, যেখানে পঞ্চমুন্ডির আসন রয়েছে। অতীতে সর্বপ্রথম এখানে বলিদান হলে সেই ঢোলের আওয়াজ শুনে সুরুলের অন্যত্র বলিদান হত। ভট্টাচার্য পাড়ার জগদ্ধাত্রী মন্দির বলে পরিচিত মন্দিরটি প্রকৃতপক্ষে একটি দুর্গামন্দির। আনুমানিক ৮০ বছর আগে এই মন্দিরেই জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়েছিল। ৪০-৫০ বছর আগে গ্রামের সর্বস্তরের মানুষের কাছে রসিদ কেটে চাঁদা তুলে জগদ্ধাত্রী পুজো আয়োজিত হতে থাকলে তা সর্বজনীন পুজোর রূপ নেয়। মুখার্জী পরিবার এখানে দুর্গাপুজোর অন্যতম আয়োজক। গত শতকের ষাটের দশকে একসময়ের বন্ধ হয়ে যাওয়া দুর্গাপুজো আবার মুখার্জী পরিবারের তত্ত্বাবধানে ‘ঘটে পটে’ শুরু হয়। বর্ধমানের উল্লাসপুর নিবাসী বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার বর্ধমানের রাজবাড়ীতে চণ্ডীপাঠ, গীতাপাঠ প্রভৃতি অত্যন্ত সুচারু ও শ্রুতিমধুর করে পরিবেশন করতেন বলে তাঁদেরকে ‘পাঠক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। একসময়কার জমিদার কেশবচন্দ্র ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সুরুলে যে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল- বর্তমানে উল্লাসপুরের পাঠক পরিবার তা উত্তরবাধিকার সূত্রে আজও আয়োজন করে থাকেন। আনুমানিক দেড়শো বছর আগেকার এই দুর্গাপুজোর পাশাপাশি সুরুলে শিবপুজো ও প্রাচীন আদি শ্রীশ্রীশ্যামসুন্দরের নিত্যসেবার দায়িত্ব পালন করে থাকেন এই পাঠক পরিবার।
উনিশ শতকের প্রথম দিনে সিউড়ির কড়িধ্যা সংলগ্ন রাউতারা নিবাসী সুদূর বৃন্দাবন থেকে আনা কালাচাঁদ মহাপ্রভুর সেবাইত আউল গোস্বামী ও বাউল গোস্বামীর বংশধর রাধারমণ গোস্বামী কোনও একটি সূত্রে প্রায় বোলপুর ও সুরুলে আসতেন। অন্যদিকে সুরুল, মতান্তরে লাভপুর নিবাসী নি:সন্তান মাখনলাল দে আনুমানিক ১৩৩১ বঙ্গাব্দে একটি দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। প্রায় ৫৫ বিঘা জমিজমার অধিকারী মাখনলাল একটি অর্পণনামা করেন এই মর্মে যে তাঁর অবর্তমানে যিনি এই পুজোর দায়িত্ব নেবেন, তিনি সমস্ত সমান্তির ভোগ দখল করবেন। গ্রামের গণ্যমান্য পঞ্চব্যক্তির উদার হস্তক্ষেপে এই দুর্গাপুজোর দায়িত্বভার এসেছিল রাধারমন গোস্বামীর উপর। তাঁরই তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ বর্তমানে ওই গোস্বামী পরিবারের দুর্গাপুজো দুটি পৃথক ভাগ করে চালিয়ে আসছেন।
সুরুল দক্ষিণপাড়ার অন্তর্গত সপ্তম পূর্বপুরুষের মুখার্জীবাড়ির সদস্যরা প্রথমে উত্তরপাড়ায় থাকতেন। তাঁরা রামায়ণ-রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝার উত্তরসূরী বলে জানা যায়। সেকারণে তাঁদের পূর্বপুরুষদের নামের আগে ‘রাম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। পরে পরিবারের একাংশ দক্ষিণপাড়ায় বসতি শুরু করেন। প্রথমদিকে তাঁদের বাড়িটি ছিল ইংরেজ আমলের মুনসেফখানা, যার বয়স তিন চারশো বছর। কয়েকবছর আগে সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে আজ একেবারে নিশ্চিহ্ন। ঠিক কোন সময় থেকে তাঁদের দুর্গাপুজো শুরু হয় তা জানা যায় না। এক সদস্য পঞ্চানন মুখার্জী ছিলেন ছোট বাড়ির কুলপুরোহিত। ২০১১ সালে স্বনামধন্য ডাক্তার সুকুমার মুখার্জীর উদ্যোগে পরিবারের সকলে মিলে প্যাগোডা স্টাইলের একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন- যা সুরুলের পর্যটন মানচিত্রে স্থান পাওয়া উচিত। মন্দিরের সামনে অদূরে একটি ছোট ঘরের মধ্যে চারুচন্দ্র মুখার্জীর স্ত্রীর একটি শ্বেতপাথরের মূর্তি এমনভাবে স্থাপন করা আছে, যাঁর দৃষ্টি যেন সোজাসুজি মা দুর্গার মূর্তির সমান্তরাল। প্রায় ৩৫-৪০ বছর আগে দুর্গাপুজোর নিমিত্ত একটি দেবোত্তর ট্রাস্ট গঠন করা হয়।
মজুমদার বাড়ির দুর্গাপুজো আনুমানিক দেড়শো বছর আগেকার। পরিবারের আদি সদস্য লোকনাথ মজুমদার প্রথম এই পুজো এনেছিলেন। কনৌজ থেকে শ্রীহর্ষ নামে এক ব্যক্তি সুরুলে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে শ্রীহর্ষ মুখার্জী থেকেই মজুমদার বংশের বিস্তার বলে জানা যায়। লোকনাথের পরবর্তী বংশধর শ্যামাশ্যাম মজুমদার সেই আমলে আসামে ঠিকাদারীর কাজ করতেন। তিনি অনেক জমিজমা ও সম্পত্তির অধিকারী হলে, তাঁর আমলেই দুর্গাপুজোর কলেবর বৃদ্ধি পায়। শ্যামাশ্যামের চার পুত্রের অন্যতম প্রভাকর মজুমদার কয়লাখনির ম্যানেজার ছিলেন। সেই কারণে পরিবারের বিষয়সম্পত্তি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। কার্যত তখনই তাঁর হাত ধরেই একটি জমিদারির পত্তনও হয়। জানা যায়, সুরুলের সরকার জমিদারবাড়ি থেকেই জমিদারী কিনেছিলেন। গত শতকের ৮০-৯০ এর দশকে মাটির দুর্গামন্দির ভেঙে পাকা দালান করা হয় এবং ২০২২-এ তা সংস্কার হয়ে আরও পূর্ণতা পায়।
সুরুলের মনসাতলা নিবাসী চক্রবর্তীবাড়ির দুর্গাপুজো সুরুলের সরকার জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজো সমসাময়িক বলে পরিবার সূত্রে জানা যায়। প্রথমদিকে বহুকাল খড়ের চাল ও মাটির মন্দির ছিল। অনেকসময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভাঙা মন্দিরের উপর তালপাতার ছাউনি দিয়ে দুর্গাপুজো আয়োজিত হয়েছে। ২০০০ সালে মৃন্ময় মন্দির ভেঙে পাকা ইমারত তৈরি হয়। সুদূর অতীত থেকে বড় সরকারবাড়ির অনুকরণে ও অনুসরণে এখানকার দুর্গাপুজোর সার্বিক আয়োজন হয়ে থাকে। ২০০০ সালে নির্মিত পাকা মন্দিরের পুনর্নির্মাণ হয় ২০১৫ সালে। গ্রামের একমাত্র প্রাচীন মা মনসার নিত্য ও বার্ষিক পুজো যাঁদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয়, সেই চক্রবর্তী পরিবারই তাঁদের দুর্গাপুজোটিও করে থাকেন।
প্রায় ৭৮ বছর অতিক্রান্ত ‘সুরুল অহরাত্র মন্দির’ সংলগ্ন পালবাড়ির দুর্গাপুজো সুরুলের প্রায় সর্বকনিষ্ঠ। সুরুলের পারিবারিক পুজোগুলোর মধ্যে দুটি পুজো বনেদী সরকার জমিদারবাড়ির অব্রাহ্মণ পরিবারের, বাকি সবগুলোই ব্রাহ্মণ পরিবারের। সেক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম পালবাড়ি।
ঘটনাচক্রে এই পুজোর আবির্ভাব, কিশোরবয়স্ক এক ছেলের নিছক খেলার ছলে। এই পুজোর সূচনা ঘটেছিল পরিবারের প্রধান পুরুষ প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ পালের হাত ধরে। মৃৎশিল্পী, হরিনাম নগরকীর্তন, ভোগআরতি, কার্তিক মাসের ভোরে প্রভাতি বা টহল- নানাধরনের বৃত্তি বা পেশা আমৃত্যু তাঁর কাছে নেশায় পরিণত হয়েছিল। বাবুই কুচি কাঠি ও মাটি দিয়ে তার উপর রঙ দিয়ে এক ফুটের দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গনেশ, কার্তিক তৈরি করে পুজো শুরু করেছিলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। প্রতিমা গঠন শেষ হলে রঙ-বেরঙের কাগজ কেটে ডাকের সাজ বানিয়ে পূর্ণাঙ্গ মূর্তি তৈরি সেকালের এক বিরল ঘটনা।
ধীরে ধীরে তা বড় আকার নেয়। অহরাত্র মন্দিরের মাটির চালাঘরে সেই প্রতিমা স্থান পায়। গ্রামের পাঁচজন আর্থিক ও নানাদিকে সাহায্য করতেন।
২০২০ সালে রবীন্দ্রনাথের বড় পুত্র বামাচরণ একটি দুর্গামন্দির স্থাপন করেন। পালবাড়ির দুর্গাপুজো নিজ বাসভবনে নির্মিত দুর্গামন্দিরেই প্রতিষ্ঠা পায়।
0 Comments