ব্রত


বিষ্ণু ঘোষ

এক

আজ দুপুরে নেমতন্ন রক্ষার্থে যেতেই হল সুপুর। শঙ্খদের গ্রাম। প্রকৃতির এক অনাবিল আনন্দময় দৃশ্য দেখতে দেখতে গাড়ি নিয়ে আমি আর আমার বন্ধু রাশেদ।  

শারদ পত্রিকা কেনার জন্য এখানে ক্লিক করুন শারদীয় এখন শান্তিনিকেতন

বেশ ভালই লাগছিল। গাড়ি ৩০-৪০ গতিতে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনে হঠাৎ করে আর একটি গাড়ি। দাঁড় করিয়েই জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদা, কেমন আছ? অনেকদিন পরে দেখা। চিনতে পেরেছ!’ কোনও উত্তর না পেয়ে বলল, ‘এই... এই এমন ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে কী দেখছ?’ আমি তো অবাক। কোনও কথাই কানে আসছে না। আমি শুধু ওর চুলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন, ‘কোনও এক শতাব্দীর এলোমেলো গন্ধ আমাকে মাতিয়ে রেখেছে। সুন্দর গন্ধ! ওঃ! বহু চেনা! সেই স্বাদ। রাশেদের ঝাঁকুনিতে আমার ঘোর কাটল। ততক্ষণে গাড়িওয়ালার সঙ্গে তার বাগযুদ্ধ চরমে। পিছনের সিট থেকে একটি সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর গলা বাড়িয়ে বলছে, ‘দাদা, কিছু মনে করবেন না। আমাদেরই ভুল। আসলে এইভাবে মাঝ রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কথা বলাটা আমার অন্যায় হয়েছে। কিছু মনে করবেন না। আই অ্যাম সরি... আসলে আমি পিছনের দাদাকে চৈতন্যদা ভেবে ভুল করেছিলাম। অনেক পুরনো আবেগ তো! তাই আর ধরে রাখতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন। উই আর রিয়েলি সরি...’। ততক্ষণে আমিও মুখ বাড়িয়ে বললাম, ‘কী রে! স্নিগ্ধা, আমার প্রতি তোর রাগ এখনও একটুও কমেনি দেখছি। আর একটু হলেই তো মেরেই ফেলতিস। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলাম।’

‘তুমি তাহলে সত্যি সত্যি চৈতন্যদা! ওফ! যাক বাবা বাঁচলাম! আর একটু হলে যা মার খেতাম না! যা বাঁচা বাঁচালে চৈতন্যদা! আগের মতো করে।’ 

‘চৈতন্য প্রায় যেতে বসেছিল। আর তুই মার খাবি কী! আমাকেই মারার উপক্রম করছিলিস।’ সে এবার এক চলতে হাসি হেসে বলল, ‘বলছি, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে এবার সত্যি সত্যি মারা পড়তে হবে। তবে, কে বা কারা মারা পড়বে জানি না। চলো, পাশে গাড়ি দাঁড় করাও। অনেক মার বাকি আছে।’ এদিকে, রাশেদ কোনও কিছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছে। কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে একবার স্নিগ্ধা, একবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আমিও কিছু বুঝতে দিলাম না। শুধু একটু বিনয়ের সুরে বললাম, ‘ভাই, গাড়িটা একটু পাশে দাঁড় করা তো! সে বেচারা কোনও কিছু বলতে না পেরে আমার বাধ্য ছাত্রের মতো গাড়িটা পাশে দাঁড় করাল। আমি হেলমেট খুলে চুল ঠিক করে দাঁড়ালাম। স্নিগ্ধা আমাকে একটু আড় চোখে দেখে নিয়ে সহাস্যে বলল, ‘তারপরে বলো, এখন কোথায় আছ? কী করছ?’ 

‘দাঁড়া, দাঁড়া! আগে একটু হেসে নিই। যা কাণ্ড করলি! ওফ!’ তারপরে দুইজনেই উচ্চ হাসিতে লুটোপুটি খেতে লাগলাম। রাশেদ, আগের মতো করেই ভাবলেশহীনভাবে চেয়ে আছে। আমি এবার তাকে ডেকে বললাম, ‘সরি ভাই, তোকে একটু পরিচয় করিয়ে দিই। ও হচ্ছে স্নিগ্ধা, আমার....’  আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে স্নিগ্ধা নিজেই বলতে লাগল। ‘থাক, আর কিছু বলতে হবে না। আর কিছু নয়। ওতেই হবে।’ তারপরে স্নিগ্ধা হাত জোড় করে নমস্কার বিনিময় করল রাশেদের সঙ্গে। মাঝখানে রাশেদ আমার দিকে একবার ইশারা করে নিয়েছে। ভাবখানা এমন যেন ‘কত মজার ব্যাপার। স্নিগ্ধা... হুম... হুম।’

আমি বিষয়টি অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘স্নিগ্ধা, বল তোর খবর কী? কোথায় যাচ্ছিলি?’ 

‘এই তো আমার মামার বাড়ি। ওখানে পুজো আছে। আজকে নবমী। খাওয়া-দাওয়া আছে।’

‘বাবা! এখনও খেতে একই রকম পারিস! যা ছিলিস তুই!’ 

‘এই শোনো, আমি একটুও বদলায়নি। আগের মতোই সব পারি। শুধু সময়টা আর নেই। আর না হলে...’ আমি কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘সে তো দেখতেই পারছি! তুই কিন্তু আগের মতোই সুন্দর আছিস।’

‘এই তোমার ফ্লার্টিং করা স্বভাবটা এখনও গেল না।’ 

‘তুই সারাজীবন এটাকে ফ্লার্টিং হিসেবেই নিলি! এইজন্যেই তো কিছু এগলো না।’

‘এই, তুমি বন্ধ করো তো!’ 

‘এই যে এখনও সিরিয়াসলি নিলি না!’ 

পাশ থেকে রাশেদ বলে উঠল, ‘এখনও ভাই কিন্তু ফাঁকা আছে। আর আমাদের গাড়িতে তিনজনের কোনও অসুবিধা হবে না।’ 

‘এই না, না।’ একটা চেনা আবদারের সুরের মতো কথাটা লাগল। ‘আমাকে আপনার বন্ধু পাত্তা দিল কোথায়!’ 

‘আমি পাত্তা দিইনি। নাকি অন্য কেউ দেয়নি।’

‘এই শোনো বাজে বকো না। আগের মতোই আছ! একটুও বদলাওনি।’  

‘কে বলল? দেখ, মধ্যপ্রদেশ একটু বেড়েছে।’ 

‘আর একটু হ্যান্ডুও হয়েছ!’ 

‘বলছিস? তাহলে একটু তো পাত্তা দে।’ 

‘না আর পাত্তা নিয়ে তোমার কাজ নেই। আগে বললে ভেবে দেখতাম। এখন নো চান্স।’ 

‘কেন রে! বিয়ে-টিয়ে করলি নাকি?’ 

‘আরে না, আমার আবার বিয়ে!’ 

‘কেন? আবার কেন? আগে হয়েছিল নাকি?’ 

‘হয়নি কী! কথাটা বলেই তার চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল।’ রাশেদ বলল, ‘ভাই, আমি পাশের দোকান থেকে সিগারেট খেয়ে আসছি। তুই কথা বল।’ 

আমি কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘কোথায় আছিস এখন?’ পাশ দিয়ে শীতের আমেজ মেশানো এক পলকা হাওয়া বয়ে গেল। সেই হাওয়া স্নিগ্ধাকে আরও স্নিগ্ধ করে দিয়ে গেল। আমি মুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতে লাগলাম। আমাকে নড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘মনে আছে, ক্যাম্পাসে থাকাকালীন আমি একবছর পুজোয় বাড়ি যাইনি। আর তুমি তো কোনওকালেই যেতে না। নবমী পুজোর দিনে তুমি সে কথা জানতে পেরে আমাকে জোর করে তুমি নিয়ে গেলে সোনাঝুরি। কত মানুষ। আনন্দ। ছবি। সেলফি। সবাই হাসছে-খেলছে। আমার মন বিষণ্ন দেখে তুমি যে কী করলে?’ 

‘মনে নেই আবার!’  

‘ওরে বাপরে! সেদিন তুমি যা পাগলের অভিনয় করলে! আমি সেটা দেখে না হেসে থাকতে পারলাম না।’ 

‘হ্যাঁ, তারপরে আমাকে কী মার! তখনই প্রথম জেনেছিলাম। লোক দুঃখ পেলে নয়। হাসলেই মারে।’ 

‘আবার, ভাল হবে না বলছি! আগের মতোই কিন্তু মারকুটে আছি।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা আর মারতে হবে না। চল, ওই পাশেই একটি চায়ের দোকান দেখছি। একটু চা খেতে খেতে কথা বলি। চল।’ চা খেতে খেতে স্নিগ্ধা বলে উঠল, ‘চৈতন্যদা, আগের মতো করে চায়ের নেশা তোমার এখনও আছে? এখনও ভোরবেলায় চা খাওয়ায় জন্য এই একটু চা পাতা হবে রে! বলে কাউকে ফোন করো।’ 

‘না রে! এখন সেই রামও নেই, আর...’

‘আর কিন্তু এখনও রাজি। তুমি একবার বললে আমি...’

‘না রে। সেটা হয় না। আমি তোকে আগেও বলেছি। আমাদের...’

‘কেন হবে না? কেন!’

‘কারণটা আমি তোকে বলতে পারব না।’

‘কেন চৈতন্যদা? কেন? কেন?’ কথাটা বলতে বলতে স্নিগ্ধা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। ওইদিকে রাশেদ এসে বলল, ‘ভাই, কথা হল? নাকি এখনও লীলা চলছে! চলবে।’

স্নিগ্ধা মুখ মুছে নর্মাল হবার চেষ্টা করতে লাগল। বলল, ‘আপনার বন্ধুর লীলা! ঠিকই বলেছেন। শত সখির সঙ্গে লীলা!’

‘এই যে... এই কথাটাই আমরা সহজপাঠে বলি। ও বিশ্বাস করতে চায় না।’ 

‘সহজ পাঠ’- স্নিগ্ধা কথাটা একটু দীর্ঘশ্বাসের সুরে বলল। আমি সেটা খেয়াল করেও বললাম, ‘আরে না না! এমন কিছুই নয়। আর বিষয়টা সহজ করে বললেও অতটা সহজ বা তার পাঠও সহজ নয়। 

‘ও সব বাদ দে! তোর মামার বাড়ি কোথায়?’ 

‘এই তো আবাদপুর’।

‘কাদের বাড়ি যাবি?’ 

‘বাবা, এমন করে বলছ যেন তোমার সবাই চেনা!’ 

‘আরে বলেই দেখ না! এই গোল পৃথিবীতে হতেও তো পারে!’  

‘বাবা রে! অনেক চেনা হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে! আচ্ছা, বলছি, বুম্বা। মানে শঙ্খ ভট্টাচার্য। চেনো নাকি?’ 

‘হ্যাঁ। চিনি তো! আলবাত চিনি। তোকে মনে হয় এবছরও এই পাগলের পাগলামি দেখতে হবে রে।’ 

‘মানে! তুমিও কি ওখানেই যাচ্ছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ম্যাডাম’। 

‘তাহলে ওঠো, আমার গাড়িতে। কোনও কথা শুনব না। তোমার বাইকটা ওই গ্রামের কোনও বাড়িতে পার্ক করে চলে এসো।’ রাশেদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে-ও যারপরনাই খুশি। এই ভাঙ্গা বাইকটা আমারই পাল্লায় পড়ে চালাতে বাধ্য হচ্ছিল। আসলে আমি পুজোর এই কটা দিন এই ‘লাল পুরনো বাইকটা’ চালাই। ওটার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। ওর একেবারেই এই লাল বাইকটা পছন্দ নয়। কালারটাই কেমন সেকেলে। ওর মতে ঠিক অতটা স্মার্ট নয়। নিখাত আমার জোড়াজুড়িতেই ওকে এটা আনতে হয়েছে। তাই, এমন লোভনীয় অফারে ও এককথায় রাজি।

আমি এবার স্নিগ্ধাকে বললাম, ‘সে তো না হয় যাব! কিন্তু তুই আগে বল, আবাদপুর তো উল্টোদিকে। তুই এইদিকে কোথায় যাচ্ছিলি?’ 

‘আসলে ওই পাঁড়ুই-এ একটা অনাথ আশ্রম আছে। ওখানে মাঝে-মধ্যে আমি গিয়েছি। বাচ্চাদের জন্য পুজোয় কিছু জিনিস কিনেছিলাম। ওইগুলোই দিতে যাচ্ছিলাম আর কী!’ 

‘বাঃ!’ আমি একটু অ্যাভোয়েডের সুরেই বললাম, ‘তুই, বরঞ্চ যা! আমি আর রাশেদ একটু এগিয়ে যায়। পরে দেখা হচ্ছে!’

‘এই শোনো, তোমাকে যেতেই হবে। ক্যাম্পাসে থাকার সময়ে তোমার লুকিয়ে, নিজে না খেয়ে অন্যদের জন্য কিছু করার কথা, প্রতি সপ্তাহে আনন্দ আশ্রমে যাবার কথা আমি কিন্তু জানি।’ আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। তবুও, সামলে নিয়ে বললাম, 

‘তুই কী করে জানলি!’ 

‘শুধু কী তুমি একা সবার খবর রাখতে পার! আমি কি কিছুই পারি না!’ যাইহোক, তোমাকে যেতেই হবে।’ 

আমি একপ্রকার কথাগুলো ঝেড়ে ফেলে বললাম, ‘না রে! আমি যাব না। সে নাছোড়বান্দা। একেবারেই ছাড়বে না। বলল, ‘কোনও কথাই শুনব না। তোমাকে ছাড়ব না।’

আমি বললাম, ‘আর তাছাড়া, সেই সবদিন আর নেই! আমি ওইসব বাজে কাজ আর করি না। তুই যা!’ 

‘আমি কোনওমতেই শুনব না। তোমাকে যেতেই হবে’।

রাশেদ বলে উঠল, ‘চল না! মেয়েটা দুঃখ পাবে! একটু না হয় ওর কথা ভেবেই চল’। 

আমি রাশেদের কথা আবার ফেলতে পারি না। তবুও, না যাবার যথাসাধ্য যুক্তির অবতারণা করলাম। কিন্তু কোনও যুক্তিই ধোপে টিকল না। শেষে সবকিছুই এই মেয়েটির বাক্যবাণের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ক্লিন বোল্ড হয়ে মাঠের বাইরে। আমিও তখন স্নিগ্ধার জেনিস গাড়ির ভিতরে। 

এসি চলছে। একটু একটু ঘামছিও। আসলে ওখানে আমি প্রায়ই যায়। ব্রতেরা যদি হঠাৎ করে এসে আমাকে জাপটে ধরে, আমি কী উত্তর দেব! এই তো কয়েকদিন আগেই সে ঘুরে এসেছে। ব্রতেরা তাকে এমনভাবে আটকে রেখেছিল যে সে আসতেই পারছিল না। এমন বাচ্চাদের হাত ছাড়াতে বা ছাড়তে কী করেই বা সে পারত। তারাই যে বাঁচার অন্যতম সম্বল। মাতৃ-পিতৃহারা সন্তানদের সে-ই যে মা-বাবা। জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে, তার ছেলেবেলার কথা! বাবা মারা যাবার পরে অনাদরে, অবহেলায় মানুষ সে। গ্রামে। প্রকৃতি, মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, বালি, খেলা- এই তো তার জীবন। আকাশে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে তার ঘুম থেকে ওঠা। তারপরে বাড়ির সামনে প্লাস্টিক ব্যাট-বল হাতে খেলা শুরু। একবার মনে পড়ে এমন খেলা খেলতে গিয়ে পাড়ার সোমনাথদার বুকে ব্যাট লাগল। তাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে হল। সে তো শুধু ব্যাট চালিয়ে খালাস। মার দৌড়। বাড়িতে তখন হুলুস্থুলস কাণ্ড। এদিকে পাড়াতে রীতিমতো মিটিং বসে গেছে। চৈতন্যের খেলা বন্ধের অর্ডার জারি হয়েছে। না হলে কিছুই করা যাবে না। এমন সব নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে খেয়াল করল স্নিগ্ধার হাতের বালাটার দিকে। যেটা আনন্দবাজারে কিনে দিয়েছিল। তাদের শেষ স্মৃতি হিসেবে সে আজও আপন অধিকার বজায় রেখেছে। পাঠভবনের এক ভাই অনেক আবদার করে বলেছিল, ‘নাও না, দাদা, দেখো এই বালা দিদিকে দিলে কোনওদিন দিদি তোমাকে ভুলবে না।’ তার কথাগুলো এখনও কানে বাজে। আজকে সেই ছোট্ট ছেলেটিকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘ভাই, তুই ঠিকই বলেছিলিস। দিদি আজও আমাকে ভোলেনি’। আসলে মানুষ কাউকেই কোনওদিন ভোলে না। সময় ও প্রয়োজন তাকে ভুলিয়ে দেয়- ভুলতে বাধ্য করে। না হলে যে সে বাঁচতে পারে না। এই বাঁচার লড়াই সত্যিই আজব ও কঠিন। সবাই বাঁচতে চায়। কিন্তু ক’জনই আর বাঁচতে পারে! হয়তো টিকে থাকে বড় জোর। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল করে, স্নিগ্ধা কখন আপন মনে গান ধরেছে- ‘পুরানো সেই দিনের কথা, সে কি ভোলা যায়।’ 

ওঃ! অনেকদিন- অনেকদিন পরে তার অপূর্ব কন্ঠস্বর তাকে আবার ভাসিয়ে নিয়ে গেল সে শালবিথী, আম্রকুঞ্জের গহীন পথে। ফেলে আসা দিনে। সেইসব সোনালি দিনের স্বপ্নের জায়গায়। গান শেষে স্নিগ্ধা তার হাতে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা চৈতন্যদা, মনে আছে তোমার, আগে তুমি আমাকে কতদিন কবিতা শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়েছ! এখনও লেখো- টেকো! নাকি সেটাও বাদ!’ সে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘আরে না, না। এখন আর সময় কোথায়! স্কুলে বাচ্চা মানুষ করতে করতে লেখালেখি গেছে’।

‘তুমি স্কুলে পড়াচ্ছ! বাঃ! আমি জানতাম তুমি ঠিক মাস্টারি-ই করবে! তোমার মতো এমন ছেলে যে মাস্টারি করবেই। তুমি যে স্কুলে পড়াও তারা ভীষণ লাকি, বলো! কত সুন্দর করে তুমি পড়াও।’

‘আরে ধ্যাৎ, তোর বাড়িয়ে বলা স্বভাবটা এখনও গেল না, দেখছি। তবে এবার মাস্টারিটা ফলাতে হবে দেখছি। তুই বড্ড বাজে বকছিস!’ 

রাশেদ এই সুযোগ পেয়ে বলে উঠল, ‘আমরাও তোমার সঙ্গে একমত। আমরা বলতে আমাদের গ্রুপ সহজ পাঠ আর কী! বললেও এতদিন বিশ্বাস হত না স্যারের! এবার প্রমাণ হল তো! এই আপনি আমাদের সহজ পাঠ গ্রুপে আসুন তো! এবার ওকে আমরা ঠিক জব্দ করতে পারব। এতদিন ঠিক লোকের অভাবে আমরা বাগে আনতে পারছিলাম না। আজকে মনে হচ্ছে ঠিক লোক পেয়েছি।’ 

‘একশোবার আসব। আপনি শুধু বলুন আমাকে কী করতে হবে। কোনও ফর্ম-টর্ম ফিলাপ বা অন্য কিছু...’ 

‘আরে না, না। আপনি একদিন আমাদের ঠেকে আসুন। তারপরে আপনাকে ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড করে নেব। ব্যস, হয়ে যাবে।’ 

‘ও! এটা আবার এমন কী ব্যাপার। একদিন গেলেই হল। তা আপনাদের ঠেকটা কোথায়? আশা করি সুবোধদার দোকান!’ 

‘আপনি তো দেখছি সবই জানেন!’ 

আমার দিকে একটু ঝুঁকে তাকিয়ে স্নিগ্ধা উত্তর দিল, ‘সবটা আর জানতে দিল কোথায়- জানতে পারলামই বা কোথায়!’ চৈতন্য এবার কথা থামিয়ে বলল, ‘অনেক হল। এবার নামো। আর জানতে হবে না। আমরা চলে এসেছি।’ বলেই সে তাকে হাত ধরে নামাতে গেল। হাতের স্পর্শেই স্নিগ্ধা কেমন যেন একটা লজ্জামিশ্রিত অনুরাগ প্রকাশ করল। চৈতন্য ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেমে গেল। দরজাটা খুলে বলল, ‘ম্যাডাম, নেমে আসুন। অনেক বকবক করেছেন। জ্বালিয়ে মারল সারাটা রাস্তা।’

‘জ্বালানোর আর দেখলেন কী মশায়! ইচ্ছে তো ছিল ছারখার করে দেবার। তার আগেই তো বারুদ ফুরিয়ে গেল’। 

‘বেশি পাকামো মারতে হবে না। এখন চল, আশ্রমে যাওয়া যাক।’

দুই

আশ্রমে পা দিতে না দিতেই সে যেটা ভেবেছিল ঠিক সেটাই হল। ব্রতেরা ওইদিকে আমবাগানে বাজি ফাটাচ্ছিল। ব্রত তাদের দেখতে পেয়ে ছুটে এসে চৈতন্যকে জাপটে ধরে। ব্রত, পূজা, একে একে রাহুল, প্রতিজ্ঞা, মহুল আরও অনেকে। ব্রতদের এমন ব্যবহার দেখে স্নিগ্ধা তো হতভম্ভ। সে শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল বাচ্চাদের সঙ্গে একত্রিশ বছরের একটি ছেলের বাচ্চা হয়ে যাওয়ার এক স্বর্গীয় দৃশ্য। তবে, তার থেকেও  নজরে পড়ল ব্রতের চোখ দুটি। ভীষণ মায়াবি। যেন তার অনেক দিনের চেনা মনে হল। সে কাছে গিয়ে তাকে আদর করল। অনেক চকলেট দিল। এবার চৈতন্যের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মশায়! আপনি যে বললেন এই সব না কি আর করেন না! আপনি না কি এদিকে আসেন-ই না। তাহলে এগুলো কীসের নমুনা!’ চৈতন্য এক মুহুর্তের জন্য হতভম্ভ হয়ে গেল। সর্তক হয়ে সামলে নিয়ে বলল, ‘না আসলে আসি না তো! ওরা বোধহয় আমাকে অন্য কেউ ভেবে...’ পাশ থেকে ব্রত বলে ওঠে, ‘তোমাকে অন্য কেউ ভাবব কেন! তুমি আমাদের চৈতন্যদা!’ চৈতন্য এবার ভাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। নিজের মনেই বলে, ‘এই রে মাটি করেছে!’ এবার সে কী করে! সব ধরা পড়ে যাবে নাকি! একবার সে ব্রতের দিকে একবার স্নিগ্ধার দিকে সে তাকায়। কোনওকিছুই বলতে পারে না। চৈতন্য ব্রতের চোখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। স্নিগ্ধার হাত তার পিঠে চটাস করে পড়ার পরে সম্বিত ফিরে আসে। স্নিগ্ধা বলে, ‘আগের মতো করেই তুমি মিথ্যা কথা বলতে পার। তবে, কী জানো, তুমি এখনও ধরা পড়ে যাও’। চৈতন্য এবার পকেট থেকে ব্রতদের কিছু চকলেট দিয়ে অন্যদিকে খেলতে পাঠায়। তারাও চকলেট পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। চৈতন্য এবার বলে, ‘আসলে আমরা সবাই একটা করে মিথ্যার আবরণ পরে আছি, জানিস। এখন আর সত্য-মিথ্যার হিসেব করি না। কতকিছুই তো এইভাবেই চলে।’

‘আলাপদা, এমন করে বলে তুমি কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছ!’

‘আলাপদা’- অনেকদিন পরে কথাটা শুনে সে চমকিয়েই উঠল। তবুও, বলে উঠল, ‘আলাপের পর্ব অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এই নাম ধরে আমাকে আর ডাকবি না!’ 

‘কেন তুমি নিজেকে এমন করে কষ্ট দিচ্ছ, বলো তো! কী হয়েছে তোমার? আমাকে তো আগে কোনওদিনই বলোনি। আজকে না হয় বলো।’ 

‘বলার কিছুই নেই। তাছাড়া, বললেও কি সব বলা হয়!’ কথাটা বলেই তার চোখ পড়ল রাশেদের দিকে। রাশেদ আশ্রমের এক কোণে একটি ছেলেকে নিয়ে আপন আনন্দে খেলা করছে। উপরের দিকে তুলছে আবার ছেড়ে দিয়ে লুফে নিচ্ছে। সে স্নিগ্ধার দিকে চেয়ে বলল, ‘ওই দেখ, এমন খেলায় আমরা সবাই আছি। ওই ছেলেটির পড়ার ভয় নেই... কেন জানিস? আসলে ওর বিশ্বাস। ও জানে আমাকে যতই উপরে তুলুক না কেন নিচের ব্যক্তি কিন্তু ঠিক লুফে নেবে। আমরাও প্রত্যেকেই এই বিশ্বাসে যদি বাঁচতে পারি তাহলে জীবনটা সুন্দর হয়ে ওঠে!’ 

এবার স্নিগ্ধা বলে ওঠে, ‘সেই বিশ্বাসেই তো বিশ্বাস রাখতে চেয়েছিলাম। মানে, এখনও চাই। শুধু বিশ্বাসী ব্যক্তিটিই তার আপন বিশ্বাসে বিশ্বস্ত হাতটি এই অবিশ্বাসীর হাতে বিশ্বাস করে দিতে পারল না।’

‘বাদ দে, ওসব কথা। চল, গুরুজীর সঙ্গে দেখা করে আসি’। 

‘বাদ দেব কেন, আলাপদা! তুমি আগের মতো করে আমাকে একবার শ্রী বলে ডাকো না!’ 

‘না আর শ্রীর এই বিশ্রী আবদার আমি আর রাখতে পারলাম না’। 

‘শোনো, আমি কিন্তু মজা করার মুডে নেই। একবার ডাকো না! প্লীজ...’

‘জোর করিস না। প্লীজ! আমি তোকে মানা করছি’। 

কথা বলতে বলতে চৈতন্য খেয়াল করল স্নিগ্ধার চোখে জলের ফোঁটা। সে একবার হাত বাড়িয়েও নামিয়ে নিল। বলল, ‘চল, আশ্রমের জিনিসগুলো দিয়ে আসি ও গুরুজিকে একবার প্রণাম করে আসি।’ 

এবার স্নিগ্ধা চৈতন্যের হাত ধরে বুকের কাছে টেনে নিল। ঠিক তখনই ব্রতদের বুড়িমার চকলেট ব্যোম ফাটার মতো আওয়াজ ‘ধুম... ধাম... ধুম... ধুম।’ স্নিগ্ধা ভয়ে অজান্তেই চৈতন্যের বুকের মধ্যে পদ্মের নিষিক্ত ফলের মতো পাপড়ির মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিল। কিন্তু পরক্ষণেই রাশেদের চিৎকারে তাদের সম্বিৎ ফিরে এল। তারা দেখতে পেল, ব্রত ব্যোম ফাটাতে গিয়ে নিজের হাতেই ফাটিয়েছে। একটু রক্ত পড়ছে। আর চিৎকার কী! কাঁদছে- ‘মা, মা’ বলে। ডাক শুনেই তারা ছুটে গেল। স্নিগ্ধার বুক ফেটে যাচ্ছে। কাছে গিয়ে নিজেই তার সেবা শুরু করে দিল। সবাই আসতে আসতে কাছে কিছু না পেয়ে এবছরের পুজোয় কেনা নতুন শাড়ির আঁচলটা ছিঁড়ে তার কাটা জায়গায় বেঁধে দিল। রাশেদ আর আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলাম। ব্রত একটু কষ্ট হলেও স্নিগ্ধার এমন স্নেহের স্পর্শে তারই কোলে ঢলে পড়ছিল। হঠাৎ গুরুজি তার ঘরে থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে বলেন, ‘বাবা, চৈতন্য, সব ঠিক আছে তো! কার যেন একটা কান্না শুনতে পেলাম।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ গুরুজি! এমনি সব ঠিক আছে। আসলে ব্রত ব্যোম ফাটাতে গিয়ে হাতে একটু লাগিয়েছে। স্নিগ্ধা, এখন ওর যত্ন করছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন’। গুরুজি আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে আবার নিজের ঘরে চলে যান। আমি নিজেই জানি না, উনি আমার কথায় বা আমার উপরে কেন এত অগাধ বিশ্বাস করেন। শুধু যাবার আগে এক নজর স্নিগ্ধাকে দেখে যান। এদিকে, ব্রতকে ‘বাবা-বাছা... কিছুই হয়নি... কই দেখি... কোথায় লেগেছে... কিছু হবে না...’ ইত্যাদি বলে হাতটা ভাল করে বেঁধে দিয়ে কোলে তুলে নিল স্নিগ্ধা। চৈতন্য এক বোতল জল এনে দিল। সেটা ব্রতকে খাইয়ে একটু সুস্থ করে তুলল। এবার তারা তাকে নিয়ে ভিতরের ঘরে গেল। রাশেদ আশ্রমের সর্বক্ষণের সঙ্গী শিবুকে গাড়িতে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল কানাই ডাক্তারের খোঁজে। ঘরে এখন স্নিগ্ধা ও চৈতন্য এবং প্রায় ঘুমে ঢুলে পড়া ব্রত। 

তিন

ঘরের এই নিস্তব্ধ পরিবেশে ব্রত এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র দুটি মানুষ সজাগ আছে, অতন্দ্র পাহারাদারের মতো। এখন আর কোনও ভয় নেই। এবার চৈতন্য আস্তে আস্তে বলে, ‘স্নিগ্ধা, ডাক্তারবাবু চলে আসবে। আর কিছু হবে না। এবার তুই মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়। আমি আর রাশেদ একটু পরেই না হয় যাব।’ 

‘সেটা হয় না, চৈতন্যদা। একসঙ্গেই যাব। আর তাছাড়া, তোমাদের বাইক তো ওই দূরে গ্রামে পার্ক করা আছে। সে এখান থেকে অনেকটাই। যেতে হলে একসঙ্গেই যাব আর না হলে বিকেলের দিকে গিয়ে দেখা করে আসব।’ 

‘কেন মিথ্যে পাগলামি করছিস? এখনই বেরিয়ে পড়’। 

‘মিথ্যে’- কথাটা যথেষ্ট টেনেই বলল সে। 

‘তুমি কোনওদিনই বুঝলে না। শুধুই সত্য আর মিথ্যার মাঝখানে নিজে নয়, অন্যকেও ঝুলিয়ে রাখলে। আগেও তুমি এমন করেই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে! মনে আছে সে কথা!’ 

‘না, আমার কিছুই মনে নেই। আর মনে করতেও চাই না।’

‘চাই না বললেই তো আর আটকানো যায় না।’ 

‘আচ্ছা, একটা কথা বলো তো তুমি একদিনের জন্যে হলেও ভুলে থাকতে পেরেছ?’ 

‘আমি জানি না’। 

‘বলো, বলবে না। আসলে তোমাদের ছেলেদের এটাই দোষ, বুক ফুটবে তবুও, মুখ ফুটে কিছুই বলবে না।’ 

জানালার দিকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে এবার সে বলে, ‘এই ব্রতের হাতটা একটু ভাল করে দেখ তো! এখনও রক্ত পড়ছে কি না?’ 

‘না, পড়েনি। তবে, অন্য কারও ক্ষত স্থানে রক্ত বের না হলেও তীব্র যন্ত্রণায় সে কাতর হয়ে উঠেছে। অন্যান্যদের সঙ্গে সঙ্গে যদি একটু সেদিকে নজর দিতে! তাহলে...’

এমন সময় ব্রত হঠাৎ ‘মা, মা’ বলে ডেকে উঠে। স্নিগ্ধা ‘এই তো! বাবা, কিছু হয়নি... এই তো আমি আছি... বাবা ঘুমাও’ বলে তাকে বিরত করে। 

‘আচ্ছা, চৈতন্যদা, মনে আছে ২৫ জুলাইয়ের কথা। শালবিথীর সেই বেদির গোপন আলাপের মুখোমুখি আলাপের কথা।’ চৈতন্য একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল দূরে নাগলিঙ্গম ফুল গাছটির দিকে। ‘কীগো! উত্তর দিচ্ছ না যে, বড়! নাকি সব কিছুই ভুলে গেছ!’

‘মানুষকে বেশি কিছু মনে রাখতে নেই। তাহলে নতুন কিছু জমা হবে না। নতুনদেরও তো জায়গা দিতে হবে।’

‘এই শোনো, আমি তোমার দার্শনিক মতামত চাওয়ার জন্য কথাগুলো বলেনি’। 

‘জীবনে দর্শন না থাকলে কী আর জীবনটা জীবন থাকল রে!’ 

‘ও দর্শন তোমার কাছে রাখো। জানো, সেদিন তুমি যদি আমাকে না বোঝাতে, আমাকে বাধা না দিতে, চোখের সামনে সব সত্যি তুলে না ধরতে তাহলে আজকে হয়তো এই স্নিগ্ধাকে দেখতেই পেতে না।’ 

‘এই যে পাকা বুড়ি, এবার থামো। অনেক হল।’ 

‘না, থামব না। আসলে তোমার কাছে আমার ঋণের কোনও শেষ নেই। ২৫ নম্ভেম্বর-এর সেই কালরাত্রি কথা আমি ভুলি কী করে, চৈতন্যদা।’ 

‘এই এই অনেক হল। আবার, আমি তোকে মারব। আমি কিন্তু মারতেও পারি’। 

‘হ্যাঁ, পাকা বুড়ো একটা। খুব পার। শোনো, হোস্টেলে তোমার নামে এই মারামারির বাহাদুরির খেতাব থাকলে আমার কাছে কোনওদিন সেই সৎ সাহস দেখানোর সুযোগ পেয়েছ!’ 

‘তুই কত দিয়েছিলি যেন আমাকে!’ 

‘দিলে মনে হয় একেবারে মেরেই ফেলতে, নাকি?’ 

‘সেটা তো নির্ভর করছে কে ও কোন পরিস্থিতিতে দিচ্ছে।’ এমন সময় দরজায় রাশেদের গলা। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে তারা উপস্থিত। ‘এই যে, ডাক্তারবাবু, এইদিকে আসুন’ বলতে বলতে শিবু ডাক্তারবাবুর ব্যাগ হাতে সেখানে প্রবেশ। আমি ডাক্তারবাবুকে বসার চেয়ারটা এগিয়ে দিলাম। স্নিগ্ধা যথারীতি ব্রতের মাথার সামনে বসে ওর হাত ধরেই ছিল। ডাক্তার ব্রতকে দেখে ‘ভয়ের কিছু নেই’ বলে একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে চলে গেল। আমি পিছন পিছন গেলাম। তারপরে ঘরে এসে রাশেদকে বললাম, ‘ভাই, এবার চল, না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে! বেলা বেশ হল!’ 

‘এই যে মশায়! আমাকে কি বাদ দিয়ে যাবার কথা ভাবছেন। শুনুন, খুব একটা বেলা হয়নি। সবেমাত্র দুপুর বারোটা বাজছে। আর একটু কাজ বাকি আছে! সেগুলো করে একসঙ্গেই রওনা দেওয়া যাবে।’ 

রাশেদ বলল, ‘সেটাই ভাল। অন্তত আমাকে ওই লাল বাইকটা আর চালাতে হবে না! ওফ!’ বলেই চৈতন্যের দিকে একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসল। 

সে শিবুদাকে বলল, ‘এই চল না, একবার গুরুজির সঙ্গে দেখা করি আসি’। আসলে রাশেদও আমার সঙ্গে এই আশ্রমে বেশ কয়েকবার এসেছে। গুরুজির সঙ্গে ওর রীতিমতো একটা হৃদ্যতা তৈরি হয়েছে। ও বলে, ‘এমন সরলমনা অথচ অগাধ পাণ্ডিত্য না কি আগে কখনও দেখেনি।’ যাই হোক, তারা বেরিয়ে যাবার পরে, স্নিগ্ধাও বলল, ‘তুমি একটু বসো, আমি একটু আসছি।’ আমি জিজ্ঞেস করতেই যাব ‘কেন?’ সে-ই বলল, ‘বাড়ির বাগানের কিছু ফল মা জোর করে এই বাচ্চাদের জন্য পাঠিয়েছে। আমি সেগুলো নামাতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওইগুলো একটু দিয়ে আসছি।’ 

এবার চৈতন্য ব্রতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে- ছেলে যেন সদ্যজাত শিশু। অনেক কান্নার পরে মাতৃদুগ্ধ পান করে আরামে নিদ্রা দিচ্ছে। অনেকদিন পর ব্রতের মুখে এমন প্রশান্তির নিদ্রা তাকেই বেশ আনন্দ দিয়েছে। আসলে একদিন সে-ই ব্রতকে এই আশ্রমে নিয়ে এসেছিল। সেদিন তার বয়স মাত্র একদিন। প্রবল কান্নার সুরে শুধু নিজেকে নয়, সমগ্র আশ্রম প্রাঙ্গনকে মুখর করে তুলেছিল। সে বলেছিল যেন ‘আমি এসেছি নতুন জীবনের বার্তা নিয়ে। আমাকে তোমরা বরণ করে নাও।’ গুরুজি ও আশ্রমের অন্যান্য সদস্যেরা নানা চেষ্টা করে অনেক কষ্টে তাকে ঘুম পাড়াতে পেরেছিল। তারপরে অনেক ঝড়-ঝঞ্জা পেরিয়ে আজকের এই ব্রত। ওর প্রতি চৈতন্যের মায়া একটু বেশিই। ব্রতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে তার অনেককিছু। 

চার

চৈতন্যের থেকে স্নিগ্ধা দুই বছরের জুনিয়র। প্রথম পরিচয় বিভাগের নবীনবরণে। প্রথম দেখাতেই চৈতন্য দেখেছিল একটি আপাত শান্ত মেয়ে বিভাগের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওঃ! কী লাগছিল সেদিন! সবুজ শাড়ি ও কালো ব্লাউজ পরে এসেছিল সে। হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিল চুল। মুখের সামনে দু’গাছা চুল ঠিক করতে করতে চোখাচোখি হয়েছিল পরস্পরের। পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাবার সময় চৈতন্য পেয়েছিল সুন্দর একটি মিষ্টি গন্ধ। যা আজও সে ভুলতে পারেনি। সবুজ পাঞ্জাবি ও উত্তরীয় পরে চৈতন্যকেও খুব একটা মন্দ দেখাচ্ছিল না। তাকে অনুষ্ঠানের অ্যাঙ্কারিং করতে হবে যে! ওর গলার স্বর ও স্পষ্ট উচ্চারণের জন্য এ কাজে একবাক্যে সকলেই ওর নামই নেয়। নবীনদের বরণের তাদের নাম ঘোষণা করতে গিয়েই স্নিগ্ধার নামের সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয়। তখন কে জানত, এই স্নিগ্ধা একদিন তার ‘শ্রী’ হয়ে উঠবে- রচিত হবে ‘জীবনশ্রী’। বিভাগে ‘চৈতন্যদা’ বেশ পরিচিত নাম। আর হবেই না বা কেন! যেমন পড়াশোনায়, তেমনই তার ব্যক্তিত্ব। শুধুমাত্র দোষের মধ্যে সে একটু তর্কপ্রিয়। সব কথাকে সে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখে নেবেই। এতে অনেকে একটু ক্ষুণ্ণ হলেও পছন্দের তালিকাটাই বেশি। এমন গুণী ছেলে যে, তার উপরে সবাই রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতেই পারে না। আস্তে আস্তে উভয়ের মধ্যে কথা শুরু। তাদের বন্ধুত্বও তৈরি হয়। স্নিগ্ধা কোনওদিন চৈতন্যদা যে তাকে ভালবাসে না ভালবাসতে পারে- এমন কথা ভাবতেই পারেনি। কারণ, সে ততদিনে ইতিহাস বিভাগের এক সিনিয়র দাদার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তার নাম অলীক। অলীকের বোলপুরেই বাড়ি। ধনী বাবার একমাত্র সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই একটু বাউণ্ডুলে স্বভাবের। তবে, দেখতেও খাসা। ফুটবল খেলায় ওর সঙ্গে টক্কর দেবে- এই ভবনে খুব কমই আছে। সেটা নিয়ে ও একটু গর্বই করে। আর একটি বাজে গুণ ওর আছে। সেটা হল আজকে এ ফুল তো কালকে অন্য কোথাও। আসলে একই মেয়ের সঙ্গে সে নাকি খুব বেশিদিন থাকতে ভালবাসে না। স্নিগ্ধার সঙ্গে ওর প্রেম যখন মধ্য গগনে একদিন রাস্তায় চৈতন্যের সঙ্গে দেখা। চৈতন্য দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে চাইল। স্নিগ্ধা একপ্রকার জোর করে তার সাইকেল আটকায়। বলে, ‘এই যে মশায়! বলি, চশমা তো পড়েন না! এবার কিনে দিতে হবে দেখছি। দেখেও দেখছেন না?’  চৈতন্য একবার আড় চোখে অলীকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘চশমা থাকলেও অনেকে আবার পরিষ্কার দেখতে পায় না! দেখার মতো চোখ ও মন উভয়ই দরকার হয়, ম্যাডাম। রাস্তা ছাড়ুন, আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ আসলে চৈতন্য ও স্নিগ্ধার মধ্যে ঠিক সিনিয়র-জুনিয়রের সম্পর্ক ছিল না। তার থেকে তারা বেশি ছিল ভাল বন্ধু। যেটা অলীকও জানত। তাই, সে এই বিষয়ে আর ঢুকতে চাইল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। একই ক্লাসের হলেও চৈতন্য ও অলীকের মধ্যে খুব একটা মাখোমাখো ব্যাপার কোনওদিনই ছিল না। যাই হোক, স্নিগ্ধা কথা না বাড়িয়ে বলে, ‘আরে, পথ ছাড়ো, পথ ছাড়ো, খোকাবাবু ক্লাসে যাবেন। আমাদের দেখে শেখো চৈতন্যদা, ক্লাস বাঙ্ক মেরে মাঝে-মধ্যে একটু ঘুরলেও তো পার!’ কথাগুলো বলেই সে আর অলীক হাসতে লাগল। চৈতন্য বলল, ‘কে বলল, আমি ক্লাস বাঙ্ক মারি না! তবে যার-তার হাত ধরে ঘোরার জন্য নয়। চল, টাটা, আবার কথা হবে’। 

রাস্তায় যেতে যেতে চৈতন্য চেতনায় শুধু ওই হাসি বলা ভাল অট্টহাসির কথাই ভাবতে লাগল। তারপরে বিভাগে পৌঁছে নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেল। মনের মধ্যে এক অসহনীয় ব্যথা সে অনুভব করছে। এই স্নিগ্ধাকে তো চেনে না! যখন প্রথম সে এল, এমন স্নিগ্ধ তার চোখ-মুখ। আজ কী হয়েছে! ছিঃ ছিঃ, সে আর ভাবতেই পারছে না। ওইদিকে অমলদা ‘প্রতীকীবাদ’ না কী একটা পড়াচ্ছেন। সেদিকে মনও দিতে পারছে না। অনেক কষ্টে ক্লাস শেষ করে এসে হোস্টেলের দিকে চলে গেল সে। এইভাবেই চলতে থাকে দিন। স্নিগ্ধাকে অনেক বোঝানোর পরেও সে কিছুতেই বুঝতে চায় না। অলীকের মতো ছেলেদের সে খুব ভালভাবে চেনে। এর আগেও ওর অনেক অভিজ্ঞতা আছে। আসলে কথাটা একদমই সত্যি। শুধুমাত্র প্রতিহিংসা বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে নয়, সে স্নিগ্ধার ভালর জন্যেই কথাগুলো তাকে অনেকবার অনেক রকমভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না- ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি’। তারপরে একদিন আর থাকতে না পেরে সে স্নিগ্ধাকে আম্রকুঞ্জে নিয়ে যায়- একপ্রকার জোর করেই। দেখে সামনে অলীক ও ওদেরই বিভাগের স্বপ্না। দুজনে খুব গল্প করছে। স্নিগ্ধার চোখমুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। কী করবে ভেবে উঠতে পারছিল না। ওদের কাছে যাবার চেষ্টা করল। চৈতন্য বাধা দিয়ে বলল, ‘না, এখন নয়। আগে তুই সবটা দেখ। অবশ্য দেখার মতো সহনশীলতা যদি তোর থাকে।’ একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল তারা। তবে, তাদের কথাবার্তা সবটাই শোনা যাচ্ছিল। দেখাও যাচ্ছিল স্পষ্ট। চাঁদের আলোয় অলীক ও স্বপ্না ওদের খেয়াল করেনি। আস্তে আস্তে শুনতে পায়, অলীক বলছে, ‘স্বপ্না, তুমি আমার জান! তোমাকে না দেখলে আমি থাকতে পারব না’। স্বপ্না লাজুক হেসে বলে, ‘তাহলে তুমি যে স্নিগ্ধার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করো’। 

‘আরে ওটা তো জাস্ট ফ্রেন্ড। আচ্ছা, তুমি বলছ, এবার আমি আর ঘুরব না’। 

‘সত্যি’।

একেবারে ‘সত্যি, সত্যি, সত্যি, তিন সত্যি’। এই বলে সে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় স্বপ্নার ঠোঁটে। অন্যদিকে, প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়ে স্নিগ্ধা। রাগে-অভিমানে জ্বলতে থাকে। মনে হচ্ছিল ‘এক্ষুণি জানোয়ারটার মুখোশ খুলে দিয়ে দু’গালে দুটো চড় বসিয়ে দিই’। কিন্তু যাবার আগেই চৈতন্য ওর হাতটা ধরে ওকে আটকালো। বলল, ‘এখনও সময় আসেনি। চল।’ 

তারপর বকুলবিথীর পথ ধরে তারা হাঁটতে লাগল। স্নিগ্ধা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হঠাৎ পাঠভবনের মেয়েদের হস্টেলের কাছে এসে সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মুখ লুকিয়ে দিল চৈতন্যের বুকে। কেঁদে কেঁদে বলে উঠল, ‘জানো, চৈতন্যদা, আমি ওকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালবাসতাম। বিশ্বাস করতাম।ও যা বলত কোনও প্রতিবাদ ছাড়াই শুনতাম। এমনকি, তোমাকে নিয়েও নোংরা নোংরা কথা বলত। আমি ভিতরে ভিতরে বিশ্বাস না করলেও কোনওদিন প্রতিবাদ করতাম না। আমি ওকে বিশ্বাস করে আমার সবটা দিয়ে কাছে পেতে চেয়েছিলাম। আর আজকে এই পরিণতি।’ 

চৈতন্য ওর মুখ তুলে বলে, ‘আসলে কোনওকিছুই অতি ভাল নয়। এই যে ফার্স্ট ইয়ারে তুই এসে যা শুরু করেছিলিস! এত ভালবেসে ছিলিস! এই বেশি জিনিসই প্রকৃতি বেশিক্ষণ সহ্য করে না রে!’ 

‘এখন আমি কী করব, চৈতন্যদা! কী নিয়ে বাঁচব!’

‘কিছু না! তোর মতো মেয়ের আবার কিছু লাগে না কি রে! তুই তোর মতো করে বাঁচবি! শান্তিনিকেতন, গুরুদেব ও পড়াশোনা নিয়ে। নিজের জন্য না হোক, বাবা-মায়ের কথাটা একবার ভাব। তাঁদের জন্য তো কিছু করতে হবে, না কি! পাগলি কোথাকার একটা! চল, অনেক রাত হল, এবার হস্টেলে চল।’ এই বলে তারা একটু হাঁটা শুরু করে। স্নিগ্ধা একটু আবদারের সুরে বলে, ‘আর একটু থাকি না, চৈতন্যদা!’ 

‘একদমই না। অনেক রাত হয়েছে। বেশিক্ষণ থাকলে সিকিউরিটি গার্ড এসে তোকে এবার তুলে নিয়ে যাবে!’ 

‘ভাল হবে না বলে দিচ্ছি! তুমি মিথ্যে মিথ্যে আমাকে ভয় দেখাচ্ছ!’ এই বলে সে চৈতন্যকে মারবে বলে দৌড়াতে থাকে। ওইদিকে পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে আরও উজ্জ্বল হয় এবং আরও জ্যোৎস্নায় আলোকিত হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতন।

পাঁচ

আজ মহালয়া। আর কিছুদিন পরেই ছুটি। সবাই বাড়ি যাবে। সকাল থেকেই গৌরপ্রাঙ্গণে ছেলেমেয়েদের ভিড়। একপাশে এসে বসেছে চৈতন্য ও স্নিগ্ধা। তাদের কথা হচ্ছে আনন্দবাজারের দোকানের নাম নিয়ে। চৈতন্য বলছে ‘সহজতা’ কিন্তু স্নিগ্ধার নাম ‘আমাদের পাঠ’। এই নিয়ে তুমুল তর্ক। এরই মাঝে অমর্ত্যদা এসে পড়লেন। বললেন, ‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে শুনি, দুজনের’। তারা দাদাকে দেখে যারপরনাই লজ্জিত। এর আগে এটা নিয়ে দুজনে দুজনকেই নানান কথা শুনিয়েছে। আসলে, বিভাগের সকল সমস্যার সমাধান হলেন অমর্ত্যদা। যেকোনও কথাই তারা অনায়াসে, বিশ্বাস করে দাদাকে বলতে পারে। তিনিও সব সমস্যার সমাধান হাসি মুখে করে দেন। কথা শুনে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, এত তর্কের কোনও দরকার নেই। দুজনেরই থাক। দোকানের নাম বলবে সহজ পাঠ।’ নামটা শুনেই দুজনেই খুশি। দাদা বললেন, ‘আচ্ছা, চৈতন্য একবার এইদিকে আয় তো! এই রেলিং-এর এই জায়গাটা নিয়ে কী একটা সমস্যা হচ্ছে। একটু দেখতে হবে।’ ওদিকে স্নিগ্ধা এত ঝগড়ার পরেও মাধবীফুলের গাছের দিকে তাকিয়ে গান ধরে, ‘ভেঙেছো দুয়ার, এসেছে জ্যোর্তিময়’। সন্ধ্যাবেলায় চৈতন্য আনন্দবাজারে উপস্থিত। ‘এষণা’ পত্রিকা উদ্বোধনের পরে স্নিগ্ধাকে নিয়ে মেলায় বের হয়। ঘুরতে ঘুরতে তাদের সামনে পাঠভবনের এক ভাই এসে বলে, ‘নাও না, দাদা, এই বালাটা, আমি নিজে তৈরি করেছি। দেখো, এই বালাটা দিদিকে দিলে দিদি তোমাকে আর কোনওদিন ভুলবে না।’ স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, বালাটির দিকে ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর স্নিগ্ধাকে বালাটি কিনে তার হাতে দেওয়ার সময় সে বলে, ‘এমন করে আমি নেব না। যদি দিতেই হয় তাহলে পরিয়ে দাও’। আমিও এই সন্ধ্যের আলো-আঁধারি ছায়ায় তার হাতে পড়িয়ে দিলাম বালাটি। তখন থেকে দেখতাম ও একদিনের জন্যেও বালাটি নিজের হাতছাড়া করেনি। যাই হোক, তারপরেই পুজোর একমাস ছুটি। চৈতন্য অবশ্য এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি গেলেও বাকি সময়টা এখানেই কাটাবে। কারণ, তার পরিচিতি, গ্রামের থেকে এখানেই বেশি হয়ে উঠছে। 

একমাস পরে ২৫ নম্ভেম্বর, আবার যথারীতি ক্লাসে সবাই উপস্থিত। বিকেলের দিকে একবার দেখা হয় স্নিগ্ধার সঙ্গে। সেভাবে আর কথা হয়নি। রাত্রে চৈতন্য হস্টেলে নিজের স্টাডি টেবিলে পড়ছে। সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ালেও, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, মজা করলেও রাত্রি ১১টার পরে সে আর কারও নয়। নিজের স্টাডি টেবিলে। সবাই এ কথা জানে। প্রায় অর্ধরাত্রি অবধি চলে তার এই কাণ্ড-কারখানা। তাকে এই সময় খুব একটা কেউ জ্বালাতন করার সাহস পেত না। একবার তারই বন্ধুরা মিলে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। দরজায় লাথি মারতে গিয়ে অনলের পায়েই লেগেছিল। ঘর থেকে চৈতন্য বেরিয়ে এসে যা কাণ্ড করেছিল- সে আর বলার নয়। এমন সময় একটা নতুন নাম্বার থেকে ফোন আসে। ওপার থেকে স্নিগ্ধার রুমমেট পায়েলের গলা। বলে, ‘চৈতন্যদা, তুমি কোথায় আছ? স্নিগ্ধা কেমন করছে! অনেক বমিও করেছে। পারলে একবার পিএম হসপিটালে এসো। আমরা এখানেই আছি।’ চৈতন্য থতমত খেয়ে বলে, ‘কেন রে! কী হল?’ 

‘এত কথা এখন ফোনে বলতে পারব না। তাড়াতাড়ি এসো।’ চৈতন্য একটি টি-শার্ট পরে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পিএম-এর উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দেখে স্নিগ্ধা ভর্তি। ডাক্তার অনির্বাণের সঙ্গে পায়েল কথা বলছে। সে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। ডাক্তারবাবু তার খুব কাছের। অনির্বাণদা লেখালেখি করতে ভালবাসেন। একসঙ্গে অনেক লেখালেখি তারা করেছে। অনির্বাণদার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ডাক্তারবাবু তাকে বাইরে একটু বসতে বলেন। অনেকক্ষণ পরে পায়েল বেরিয়ে এল। সে অত্যন্ত ব্যগ্রের সুরে জানতে চাইল, ‘কী হল? কী বললেন অনির্বাণদা?’ পায়েল একেবারে চুপ! কোনওকথাই তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। শুধুই তার চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল পড়ল। চৈতন্য ওকে একটু নাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘কীরে বলবি! না কি এখনও চুপ করেই থাকবি! বল!’ তারপরে পায়েল ওকে বলল, ‘কী করে যে তোমাকে কথা বলি! আসলে মেয়েরা ভীষণ অসহায়! তাদের একটু সামলে চলা উচিত।’ 

‘কী হয়েছে সেটা তো বল। দেখ, আর নিতে পারছি না। প্লীজ, তাড়াতাড়ি বল।’ 

‘বললে তুমি বিশ্বাস করবে?’

‘তুই বল তো! বাকি বিশ্বাস-অবিশ্বাস আমার উপরে ছেড়ে দে। আরে, বল!’ 

‘বেশ, তাহলে শোনো, স্নিগ্ধা...’

‘কী বল? স্নিগ্ধা কী...’ 

‘স্নিগ্ধা প্রেগনেন্ট!’ বলেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। 

চৈতন্যও যেন চেতনা হারায় হারায় অবস্থা। পায়ের তলার মাটি সরে যায়। তবুও, নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘কতদিনের?’ 

‘মনে হয় চারমাস। তুমি একবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে নিও।’ 

‘আচ্ছা, ও আগে কিছুই কি বুঝতে পারেনি? মানে, কোনও লক্ষণ- এই বমি, অনিয়মিত পিরিয়ডস- কোনওকিছুই।’  

“না, আসলে পুজোর আগে থেকে ও বলত, ভাল লাগছে না। শরীর খারাপ লাগছে। ভাল করে খেতে পারত না। শুধু বলত, ‘আমার কিছু ভাল লাগছে না। ঘুম ঘুম পাচ্ছে! পুজোতে বাড়ি যাবার আগে বলছিল আমার শরীরের কোনও শক্তি পাচ্ছি না।’ আমরা এমনি বিপি কম বা অন্য কোনও সমস্যা বলে অতটা গুরুত্ব দিইনি। আচ্ছা, ও তোমাকে কিছুই বলেনি?” 

‘না তো! অলীকের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পর ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে থাকত। তারপরে অনেক কষ্টে ওকে নর্মাল করি। কিন্তু এমন ঘটনার কথা আমি তো... যাইহোক...’ এরপরে সে ডাক্তারবাবুর ঘরে ঢোকে। অনির্বাণদার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে চোখ লাল করে বেরিয়ে এসে অলীককে একটা ফোন করে। কিন্তু ওয়েটিং আসে বারবার। বাইরে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরায় চৈতন্য। মাথা কাজ করছে না। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে ওঠে। ওপার থেকে অলীক বলে, ‘কী বস, সব ঠিক আছে তো! এত রাত্রে আমাকে ফোন কেন? জানিস তো ভাই, আমি এইসময় একটু ব্যস্তই থাকি! বল, কী বলছিলিস?’ 

চৈতন্য বলে, ‘ভাই, তুই একবার পিএম-এ আসতে পারবি? একটু আর্জেন্ট ছিল।’

ওপার থেকে অলীক মজার সুরে বলে, ‘কেন বে! তোর বউ প্রেগনেন্ট নাকি?’ 

‘আমার নয়! তোর কুকর্মের ফল। স্নিগ্ধা এখনও এখানেই আছে। তাড়াতাড়ি আয়।’

‘কী বলছিস! কোন স্নিগ্ধা! কত নম্বর রে!’ 

‘দেখ, মজা করছি না। তাড়াতাড়ি আয়। ও প্রেগনেন্ট।’ কথাটা শুনে অলীক হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, ‘আরে, ভাই, কনগ্রাটস! কিন্তু আমি এখন যে যেতে পারব না।’ 

‘পারবি না, মানে!’ 

‘শোন ভাই, কে কবে কী করে গেছে- এখন আমার নাম দিয়ে চালাস না।’ 

‘মানে? কে, কী করে গেছে মানেটা কী!’

‘মানে আবার কী ! কী যেন নাম বললি, ও! স্নিগ্ধা! আমার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, সে মাস পাঁচেক হয়ে গেল। আর তুই বলছিস, আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।’ 

‘কেন? তুই কী করেছিস- তোর কিছু মনে নেই?’

‘শোন, আমি এইসব ঝামেলা নিতে পারব না। দায়িত্বও না। তাছাড়া, শুনেছি ও এখন তোর সঙ্গেই ঘোরে। নিজের মাল আমার নামে কেন চালানোর চেষ্টা করছ, বাবা!’ 

‘মানে! কী বলতে চাইছিস তুই?’

‘আমি তো পরিষ্কার বাংলাতেই বললাম। বুঝতে কোনও অসুবিধা হলে বল, একটা ফেসবুক পোস্ট করে দিচ্ছি।’ 

‘তুই তাহলে আসবি না!’ 

‘আরে না, গুরু, তুমি সামলাও। শোন, এই বিষয় নিয়ে আর আমাকে ডিস্টার্ব করবি না। আমার অনেক কাজ আছে। দাঁড়া, কে যেন একটা ফোন করছে। রাখছি!’ 

‘বেশ, তুই যখন কোনও দায়িত্ব নিবি না তখন কাকুর কাছে আমাকেই দায়িত্ব নিয়ে তোদের ছবি, ভিডিও ও চ্যাটগুলো নিয়ে যেতে হবে দেখছি।’ 

‘ভাই, কী বলছিস এইসব তুই! ভুলে যাস না আমি লোকাল ছেলে! আর ওটা আমারই বাবা।’ 

‘হ্যাঁ জানি তো! অনেক লোকাল-এক্সপ্রেস আমিও চিনি। তুইও ভুলে যাস না আমি চৈতন্য। আমারও একটু-আধটু চেনা, পরিচিতি এখানে আছে।’ অলীক একটু ভয় পায়। কারণ, চৈতন্য বাইরে থেকে এখানে এলেই ওর মিশুকে স্বভাবের জন্য এখানে ও ভালই একটা পরিচিতি তৈরি করেছে। বেশ ভাল লোকজনের সঙ্গেই ওর ওঠা-বসা। তাই অলীক এবার একটু নরম হয়ে বলে, ‘দেখ, ভাই! কবে কোথায় কী করেছি মনে নেই! এইসব কথা আবার বাবার কাছে গিয়ে কী লাভ! বাবা, জানতে পারলে আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করবে। তুই ব্যাপারটা একটু সামলে নে, ভাই।’ 

‘আমি আবার কী করব?’ 

‘ভাই, যা টাকা-পয়সা লাগে তুই নে। ওকে অ্যাবরশন করে নিতে বল।’ 

‘কী বলছিস এটা তুই অলীক!’ সে চিৎকার করে ওঠে। 

‘কেন ভাই? একটা ভুল হয়ে গেছে! এটা কী এমন ব্যাপার! প্লীজ ভাই, এটা করিয়ে দে!’ 

‘না, এটা আমার পক্ষে কোনওমতেই সম্ভব নয়। একটা নতুন প্রাণ! ছিঃ ছিঃ। এটা আমি ভাবতেও পারব না। সে কী দোষ করেছে আমাকে বলতে পারবি?’ 

‘ভাই, দেখ! আমি এইসব কিছুই জানি না। প্লীজ ভাই, এবারের মতো বাঁচিয়ে দে। এখন তোকে টাকা ছাড়া আর কোনওভাবেই সাহায্য করতে পারব না। ভাই, আমি জোড় হাত করছি, তোর পায়ে পড়ছি। প্লীজ...’ 

‘কিন্তু স্নিগ্ধার কী হবে? ওর কথাটা একবার ভাব।’

‘ভাই, তুই তো জানিস, আমার বাবাকে! এ কথা জানতে পারলে আমাকে মেরেই ফেলবে। তুই স্নিগ্ধাকে একটু বুঝিয়ে বল... আমি না হয় ওকে কিছু টাকা...’ 

‘চুপ, জানোয়ার! এইসব কী বলছিস তুই! শোন, আমি দেখছি! কী করা যায়!’

‘ভাই, বলছি, ছবি, চ্যাট ওইগুলো...’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোর কোনও চিন্তা নেই... আমি দেখছি।’ 

‘ভাই, থ্যাঙ্ক ইউ... থ্যাঙ্ক ইউ... তুই যে কী বাঁচা বাঁচালি! তোকে কী বলে ধন্যবাদ দেব! চৈতন্য যুগ যুগ জিও।’  

‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। তুই রাখ। আর বেশি কথা বলিস না।’ ফোনটা রেখে দিয়ে সে আর একটা সিগারেট ধরায়। উদ্‌ভ্রান্ত পথিকের মতো নিজের ভাবনা ভাসিয়ে দেয় পিএমের বকুল গাছটার তলায় বসে। এমন সময়ে পায়েলের ফোন। বলে, ‘চৈতন্যদা, একবার ওয়ার্ডে এসো তো! স্নিগ্ধার জ্ঞান ফিরেছে।’ ওয়ার্ডে এসেই দেখে স্নিগ্ধা শুয়ে আছে। তাকে দেখেই সে কেঁদে ওঠে।বলে, ‘চৈতন্যদা, আই অ্যাম সরি...’ চৈতন্য তার হাত ধরে বলে, ‘কোনও চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন?’

‘কী বলতাম, বলো তো! তাছাড়া, আমি তো বুঝতেই পারিনি। তুমি কি অলীকদাকে কিছু বলেছ!’ 

‘হ্যাঁ ফোন করেছিলাম’।

‘কী বলল? নিশ্চয় অস্বীকার করছে’। 

‘হ্যাঁ। ওই আর কী! অ্যাবরসনের কথা বলছে। টাকা লাগলে দেবে’। 

স্নিগ্ধা মুখটা যতটা সম্ভব বিকৃত করে একরাশ ঘৃণা ছুঁড়ে দেয় অলীকের প্রতি। তারপরে বলে ওঠে, ‘আগেই যদি তোমার কথা শুনতাম... তুমি কতরকমভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছ! আমিই বুঝিনি। আমার আর এই জীবন রেখে কাজ নেই। আমার মরাই ভাল...’ এই বলে সে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে যায়। চৈতন্য বাধা দিয়ে বলে, ‘কী পাগলামো করছিস! সবাই দেখছে... কী ভাবছে বল তো!’ 

‘দেখুক! ভাবুক! আমার মরণই ভাল। কী হবে এই জীবন রেখে...’ বলতে বলতে চৈতন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। 

তারপরের দিন সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে একটু সুস্থ হয়ে চৈতন্যের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে স্নিগ্ধা। একটা আম্রকুঞ্জের বেদিতে বসেছে দুটিতে। স্নিগ্ধা বলে ওঠে, ‘অলীকদা, মনে হয় ঠিকই বলেছিল গো! আমার অ্যাবরশনই করা উচিত।’ 

‘তুই কী পাগল হলি না কি? তোর মতো মেয়ের কাছে থেকে এমন কথা আশা করিনি।’ 

‘তাহলে আমি কী করব? কী করে মুখ দেখাব? বাবা-মাকেই বা কী বলব? বলব, তোমরা পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলে! আর তোমাদের মেয়ে...’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে। চৈতন্য তাকে ধরে তোলে এবং বুকে জড়িয়ে নেয়। বলে, ‘আমি কি এখনও মরে গেছি না কি!’ 

‘মানে?’

‘মানে আর কিছুই নয়। তোকে একটা সেমেস্টার ড্রপ দিতে হবে। আমরা প্রাণের জন্ম দেব। সব দায়িত্ব আমার। তোকে কোনও কিছুই করার বা ভাবার দরকার নেই। আর শোন, পরের মাস থেকে তোকে অন্য একটা রুমে শিফট করতে হবে। তবে, হ্যাঁ, কাকু-কাকিমাকে এখনই কিছুই বলার দরকার নেই।’ 

‘না, সেটা হয় না চৈতন্যদা।’ 

‘কেন হয় না। একটা জীবন নষ্ট করতে চাস, শুধু নিজের জীবনের জন্য। ও তো কোনও দোষ করেনি, বল।’ 

‘কিন্তু তারপরে- জন্মানোর পরে?’ 

‘পরের কথা পরে হবে। ওটা তুই আমার উপরে ছেড়ে দে।’

তারপরে সব ব্যবস্থা করে কথামতো ডাক্তারের ক্লিনিকে তারা আজ এসেছে। চৈতন্য সব ব্যবস্থা করেই রেখেছিল। বিষয়টা এত সহজভাবে বললেও এতটা সহজে সব কিছু হয়ে যায়নি। আসলে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে বলা ভাল। লড়াই করে আজকে এই ডেলিভারির দিন। মাঝে অবশ্য স্নিগ্ধা বেঁকে বসেছিল। কিন্তু চৈতন্য কোনওমতেই সেটা হতে দেয়নি। ভিতরের রুমে স্নিগ্ধা। আর বাইরে পায়েল আর চৈতন্য। পায়েল তার হাতে হাত দিয়ে বলে, ‘চৈতন্যদা, তুমি সত্যি মহান। আজ এই ছোট্ট বোনটাকে একটা প্রণাম করতে দেবে!’ 

‘আরে! কী করছিস! এখনও ডেলিভারি হয়নি। খুব টেনশন হচ্ছে।’ 

‘সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমার হাত-পা কাঁপছে।’ 

বলতে বলতে ডাক্তার রক্ষিত ও এক নার্স বেরিয়ে এল। বলল, ‘ছেলে হয়েছে চৈতন্য। আমার কাজ এবার শেষ। তুমি চাইলে ভিতরে যেতে পার।’ 

চৈতন্য বলে, ‘ডাক্তারবাবু, স্নিগ্ধা কেমন আছে?’ 

‘ও এখন ভাল। একটু টেনশনে ছিল। অজ্ঞান অবস্থায় আছে। তবে ভয়ের কোনও কারণ নেই।’ 

‘থ্যাঙ্ক ইউ... থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ... ডাক্তারবাবু, আর একটি কথা...’ 

‘জানি, জানি... আমার সঙ্গে গুরুজির কথা হয়েছে।’ 

‘থ্যাঙ্ক ইউ, ডাক্তারবাবু। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব। ভাল থাকবেন।’

‘তুমিও। আসলে আজকালকার দিনে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে। যাই হোক, ভগবান, তোমাদের মঙ্গল করুন। চলো, আসি।’ 

এবার চৈতন্য ঘরের ভিতরে ঢুকল। সঙ্গে পায়েলও। ঘরে ঢুকেই দেখল স্নিগ্ধা সুন্দর ঘুমাচ্ছে। তাকে আর ডাকল না। শুধুমাত্র পায়েলকে বলল, ‘আজকে, তোকে একটা কথা দিতে হবে?’ 

‘কী কথা?’

‘এখন তুই যেটা দেখবি সেই বিষয়টি তোকে ভুলে যেতে হবে? ছোট্ট বোন হয়ে তুই এইটুকু দাদার জন্য করতে পারবি না?’ 

‘বিষয়টা কী? সেটা তো বলো! আমার পক্ষে সম্ভব হলে অবশ্যই করব।’ 

‘সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। একটা ভালর জন্য এইটুকু মিথ্যার আশ্রয় আমাকে যে নিতেই হবে। আমি এই ছেলেটিকে নিয়ে এক্ষুণি চলে যাব আনন্দ আশ্রমে। আমার সব কথা হয়ে গেছে। তুই শুধু স্নিগ্ধাকে বলবি যে, ও মৃত সন্তান প্রসব করেছে। আর এই কথাটি কোনওদিন কারও কাছে প্রকাশ করবি না! তুই অনেক করেছিস! শুধু এইটুকু...’

‘দেখো, আজ অবধি কোনওকথাই আমি কাউকেই বলিনি। আজও আমি বাচ্চাটির মাথায় হাত রেখে বলছি, এই জীবন থাকতে এই কথা আর তৃতীয় জন জানতে পারবে না। আমার একটা মিথ্যা যদি এই ছেলের জীবন গড়ে দেয়, তার থেকে খুশির আর কী বা হতে পারে! যাও তুমি, নিশ্চিন্তে যাও।” বলেই সে ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে লাগল। চৈতন্য যখন ফিরে এল তখনও স্নিগ্ধা অজ্ঞান। তারা ওয়েটিং রুমে অপেক্ষারত। পায়েল ইশারায় জানতে চাইল, ‘সব ঠিক আছে তো!’ চৈতন্য ঘাড় নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ’। তারপরে ডাক্তারের ডাক পড়ল। তারা ঘরে যেতেই স্নিগ্ধা কেঁদে উঠল। চৈতন্য তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘কাঁদিস না। কিছুই করার নেই। দেখ, আমরা তো কম চেষ্টা করলাম না। কিছুই করার ছিল না।’ 

‘কেন? কেন! চৈতন্যদা, আমার সঙ্গেই কেন এমন ঘটে!’ 

পায়েলও দেখলাম কাঁদছে। আমি স্নিগ্ধার চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম, ‘যা হয়, মঙ্গলের জন্যেই হয়। তুই কাঁদিস না। একটু সুস্থ হয়ে নে। বাড়ি ফিরতে হবে। সামনে তোর পরীক্ষা।’ এই কথাগুলো বললেও, মায়ের মন আর কী মানতে চায়! এতদিন, এতকষ্টে থাকার পরে এই পরিণতি সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ডাক্তারবাবু এসে তাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে যান ও সে ঘুমায়।

      ছয়

এমন সময় স্নিগ্ধা তার পিঠে হাত দিয়ে বলে, ‘এই যে মশায়! এবার চলুন! পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। এবার আর দেরি করলে...’

‘হ্যাঁ রে! চল, চল। দাঁড়া, আমি একবার গুরুজিকে প্রণাম করে আসি।’ এই বলে সে গুরুজির ঘরের দিকে চলে গেল। রাশেদকে স্নিগ্ধা বলে, ‘আচ্ছা, আপনার বন্ধুর মতো আপনিও কি এখানে আসেন?’ 

‘আরে না, না। আমি আর সময় পাই কোথায়! মাঝে-মধ্যে ওর সঙ্গে এক-আধবার এসেছি।’ 

‘আচ্ছা, আপনি কী করেন?’ 

‘তেমন কিছুই না, আমার একটা অ্যাড এজেন্সি আছে।’

‘ও আচ্ছা, তা আপনার বন্ধু কি এখন কারও সঙ্গে...’ 

‘আরে না, না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ওকে কতবার বলেছি, কে শোনে কার কথা!’ 

‘কী বলে?’ 

‘কিছুই না। শুধু বলে, আমার দ্বারা আর প্রেম-ট্রেম হবে না। আর না কি বিয়ের বয়স নেই! তবে, কী জানেন, যে মেয়ে ওকে পাবে- তাকে ভীষণ লাকি বলতে হবে!’ স্নিগ্ধা অস্ফুটস্বরে বলে, ‘সে আমার থেকে ভাল আর কে জানে!’

ওইদিকে, গুরুজিকে প্রণাম করে চৈতন্য বলে, ‘আশ্রমের সবকিছু ঠিক-ঠাক চলছে তো গুরুজি!’ 

গুরুজি আশীর্বাদ করে বলে, ‘তুমি যেভাবে আশ্রমকে দেখছ...’ আমি কথাটা শেষ করার আগেই বললাম, ‘গুরুজি এমন করে বলবেন না! আপনি না থাকলে এই বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েদের যে কী হবে! সেটা ভেবেই আমি অস্থির হচ্ছি!’ 

‘শোনো বাবা, কোনওকিছুই শুন্য থাকে না। ঈশ্বর সবকিছুই ঠিক করে রেখেছেন। তুমি, আমি তো নগণ্য।’ 

‘সেটা তো ঠিকই গুরুজি! তবে, কী জানেন আগেরবার করোনার সময় যে অবস্থা হয়েছিল! ওঃ! সেকথা ভাবলেই আমার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে এখনও। তবুও, রাশেদের মতো লোকজন ছিল বলে- এই যাত্রায় রক্ষে। সে সময় ও যদি আমাদের পাশে না থাকত! কী যে হত...’ কথাটা বলতে বলতেই রাশেদ আর স্নিগ্ধা সেখানে উপস্থিত। রাশেদ বলে, ‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে শুনি।’ আমি বলি, ‘এই তোমার নামে একটু দুর্নাম করছি।’ গুরুজি বলেন, ‘তা নাম থাকলে তো একটু দুর্নাম তো হবেই। আচ্ছা, বাবা, চৈতন্য, এই মেয়েটিকে তো...’ 

‘হ্যাঁ, গুরুজি, ও হচ্ছে স্নিগ্ধা’। 

‘স্নিগ্ধা! গুরুজি একটু টেনেই কথাটা বললেন। তারপরে তাকে কাছে ডেকে দেখে বললেন, ‘মা, তুমি কি আগেও এখানে এসেছ?’ 

‘হ্যাঁ, গুরুজি, ওই দু-একবার। মায়ের সঙ্গে।’ 

‘না, আসলে তোমার চোখে অনেক কিছু দেখা যায়। কী মায়াবি! যেন মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে।’

‘ডাকুন না, মা বলেই ডাকুন না আজ থেকে।’ 

‘ঠিক আছে। তুমি যখন বলছ, আজ থেকে তুমি-ই আমাদের আশ্রমের ধীরামা।’ 

আমি শুনেই বললাম, ‘দারুণ হয়েছে নামটা। সবাই আজ থেকে ধীরামা বলেই ডাকবে।’ 

‘হ্যাঁ, তুমি বাদ দিয়ে। অত ডানপিটে ছেলের আমি মা হতে পারব না’। গুরুজি হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘মা-এর কাছে ছেলে কী আর ডানপিটে হয়। সবাই সমান। যাও, একবার মাতৃদর্শন করে এসো’। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, সেই ভাল চলো, চলো।’ রাশেদ বলল, ‘আমার গুরুজির সঙ্গে একটু কথা আছে। ওই সাবমার্সিবেলের বিষয়টা নিয়ে। তুমি আর স্নিগ্ধা এগোও। আমি এক্ষুণি আসছি।’ আমি বললাম, ‘বেশি দেরি করো না। বেলা অনেক হল।’ 

‘আরে না, না। এই তো দশ মিনিট।’ 

শরতের শিউলি বাগানের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে দুটি শিউলি ফুলের মতো প্রাণ। সাদা, গন্ধহীন হলেও কোনওকিছুর আগমন বার্তাকে জানান দেয় যেন। কোনও কথা নেই কারও মুখে। চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ, পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, আকাশে আলো-রোদের লুকোচুরির মধ্যে এই দুটি হৃদয়ের লুকোচুরির খেলাও কম চলছে না। প্রকৃতি আপন গতিতে বিসর্জন থেকে আগমনীর গান বাজিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ, স্নিগ্ধা বলে ওঠে, ‘আচ্ছা, চৈতন্যদা, আমি যদি এই আশ্রমে মাঝে-মধ্যে আসি! ব্রতদের একটু যত্ন করি তাহলে কী তোমাদের কোনও অসুবিধা হবে!’ আমি তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো করে বললাম, ‘আরে সে তো দারুণ হবে। তবে, একটা কথা আমাকে তুই আর পূর্বের কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারবি না!’ 

‘কেন?’ 

‘সব কেন- এর উত্তর হয় না রে!’ আমি এখন অন্য খেলায় মেতেছি- অন্য ব্রত-তে মেতেছি’। 

‘আচ্ছা, তাই যদি হয়, তবে তাই হোক। এই কল্যাণে আমাকে একটু হলেই স্নিগ্ধ হতে দাও। তোমার এই ব্রতে শুধু আমাকে একটু সাহায্য করতে দাও। আমিও আমার ব্রততে মাততে চাই।’ 

‘জীবনে সবার ব্রতই সবার মতো। তুই চাইলে কাজ করতে পারিস। দেখ, হয়তো তোর মতো করে খুঁজে পেতে পারিস তোর ব্রতকে। আমার কোনও অসুবিধা নেই। আর গুরুজিও তো তোকে ধীরামা বলেই মেনে নিয়েছেন। তাহলে কোনও সমস্যায় থাকল না।’ এই বলে দেবীর দর্শন করে দুটি প্রাণ এক ব্রতে যাত্রা শুরু করল। কিন্তু একজন অন্যজনের ব্রতের কথা জানতে পারল না- হয়তো আর কোনওদিনই জানতে দেবে না  ও পারবেও না।

অলঙ্করণ : কল্পনা

Post a Comment

0 Comments