বিখ্যাত সুরকার শিল্পী গায়ক জিৎ গাঙ্গুলিকে বাঙালি চেনে না, এমন নয়। কিন্তু এই জিৎ গাঙ্গুলির উল্টো দিকটাও অসাধারণ। এত বড় জায়গা পাওয়ার পরেও শেকড়ের টানে এখনও খোঁজ রাখে তাঁর বাড়ির কাজের দিদির মেয়ের রেজাল্ট কেমন হল? শুধু এ-ই নয়, তার বাড়িতে যে পেট রয়েছে তারা কেমন আছে? গান বুঝুক আর না বুঝুক, তারা জিৎ আর তার স্ত্রী চন্দ্রাণীর ফ্যান। স্বাভাবিক ভাবেই ওরাও কিন্তু এদের প্রতি ভীষণ কেয়ারিং। শরীর খারাপ হয়েছে কোনও ডগির? তা হলে মুম্বই কিংবা কলকাতা থেকে দু’জনেই ফিরে এসেছে সমস্ত কাজ ফেলে। জিতের আর একটা ভাল গুণ বা বদ গুণ হল... ও খেতে আর খাওয়াতে খুব ভালবাসে। খেতে ভালবাসাটা দোষের নয়। কিন্তু এই যে খাওয়াতে ভালবাসা! এতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়! খুব অল্প দিনের পরিচয়েও ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আমাকে দাদার আসনে বসিয়েছে... আর সেই সুবাদে দাদাকে কি কি খাওয়াতে হবে, সেই মেনু দেখলে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! জিতের মা হলেন আমাদের মাসিমা, খাওয়ানোর ব্যাপারে তাঁরও জুড়ি মেলা ভার।
যাই হোক, সব মিলিয়ে জিৎ বলতেই পারে, শান্তিনিকেতন হল এই পৃথিবীর মধ্যে ওর কাছে শ্রেষ্ঠ জায়গা। শান্তিনিকেতনে যখন রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সমসাময়িক আত্মীয়স্বজনদের ঐতিহ্যময় বাড়ি রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে... তখন এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর বাড়ি কিনে, ভগ্নদশা সেই বাড়িকে রীতিমতো সারিয়ে টারিয়ে রেখে দিয়েছে জিৎ। সেখানে সুরের সাধনা করে। এটাই তার সবচেয়ে ভাল লাগার জায়গা।
জিৎকে আমরা ভালবাসি তার গান, তার গলা, তার সুর, তার সঙ্গীত পরিচালনার জায়গা থেকে। কিন্তু মানুষ জিৎ কেমন? সেই খবর ক’জন জানে? সমাজে জিৎ তো যে-কোনও পরাজিতের কাছেই এক উদাহরণ। সে জন্যই এক ঝলক অজানা অচেনা জিৎকে উপস্থাপন করলাম ‘এখন শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার, এবারের পুজো সংখ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে কাছ থেকে দেখার পর ‘ব্যস্ত আছি’ কথাটা বলতে লজ্জা পান সঙ্গীত পরিচালক সুরকার গায়ক জিৎ গাঙ্গুলি। ব্যাপারটা ঠিক কী রকম? জিতের মুখেই শুনে নেব।
“আমি প্রথমে জানতাম না যে, উনি সুর করেন বা লেখেন। অনেক পরে সুরুচি সংঘ মানে অরূপ বিশ্বাসের ক্লাব প্রথম কলকাতার দুর্গাপুজোয় দুর্গাপুজোর গানের থিম সং বানায়। এর পরেই দিদির লেখা আসে আমার কাছে। আমি অবাক হয়ে যাই। ‘মাগো তুমি সর্বজনীন’ এই গান শোনার পর মা, আম্মি আর মাদার যে একই সত্তা, তা ভুলি কী করে! ‘মাগো তুমি সর্বজনীন আছ হৃদয় জুড়ে’ এই গানটা সবাই জানে। সারা পশ্চিমবঙ্গ জানে। কিন্তু এই যে কনসেপ্ট মা আম্মি আর মাদার এটা একই... দ্যাখো। আমরা ভাবি, লিরিকস লেখা খুব সোজা... কিন্তু তাতে তো একটা পজিটিভ থট থাকা উচিত। আমরা সব সময় আম্মিকে আম্মি বলছি, মাকে মা বলছি, কেউ মাদার বলছি... কিন্তু এটা তো একই। অথচ এই কথা দিয়ে গান বানানো কিন্তু খুব কঠিন। সহজ কাজই অনেক কঠিন হয়, তাই না? তাই এই গানটা যখন উনি আমায় দেখান, আমি বললাম... বাপ রে, এটা উনি লিখেছেন কিভাবে? আমি দিদির সঙ্গে কথা বলি এবং তখন থেকে আজ অবধি দিদির সঙ্গে গানবাজনা নিয়েই কথা হয়। পরে উনি সুর করেছেন...আর ভাবা যায় না যে কী অপূর্ব সুর করেছেন। আমি তোমায় বলি যে সুর কি করে করতে হয়? সেটা কিন্তু সুরকাররা জানেন না, এটা কিন্তু ব্লেসিংস। সবাই তো সুর করতে পারবে না। এবং সবাই গান লিখতে পারবে না এবং মিটারে গান লেখা এটা কিন্তু দিদির আছে। দিদির গান লেখা দ্যাখো একটা ছন্দ। তাতে কিন্তু সব সময় ওঁকে একটা জিনিস মেনটেন করতে হয়। গ্ৰামার। গান লেখা মানে ছন্দে গান লেখা। এত প্রপার ছন্দ যে কী বলব! এ বছরেও আমি দিদির সঙ্গে কাজ করছি। পুজোর সময় পুজোর গান নিয়ে। আমি বললাম না তোমাকে... একটি গান অসম্ভব ভাল...আমায় গাইতে দিয়েছেন গানটি, ওঁরই সৃষ্টি। তো, আমি দেখেছিলাম যে, গানের সুর এবং কথার একটা সুন্দর মেলবন্ধন। সেটা কিন্তু ওঁর মধ্যে আছে এবং আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল একটাই... আমি যা বুঝতে পারি না... অত কাজ করার পরেও উনি সময় পান কোথা থেকে? এই যে আমরা বলি, আমার কাছে টাইম নেই। এটা কিন্তু ওঁর কাছে বলতে গেলে খুব সংকোচ হবে আমার! কোথা থেকে যে এত সময় বার করেন উনি...ভাবা যায় না। গাড়িতে যাচ্ছেন, লিখে ফেলছেন। আমায় ফোন করলেন, ‘দ্যাখো তো, এটা এক্ষুনি লিখলাম। দ্যাখো তো, কেমন হয়েছে। বলো তো, কেমন হবে? জাস্ট একটা সুর করে নিয়ে, ফোনেই রেকর্ড করে নিলেন। এটা কিন্তু অনেক বড় একটা গুণ!”
—তা হলে এবারে পুজোয় দিদির লেখা জিৎ-এর সুরে গান শোনা যাবে?
—না না। দিদির সুরে, দিদির লেখায় আমি গাইছি গানটা।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। ক’টা গান গাইছ?
—আমি একটাই গাইছি, এখন অবধি একটাই গান শুরু হয়েছে আর কি। তবে এটা বলব, দিদির মতো ব্যস্ত একজন মানুষ যেভাবে গান লেখেন, সুর দেন, তার পর আমি ব্যস্ত আছি কথাটা বলতে লজ্জা পাই। সত্যিই এখন লজ্জা পাই, কারণ উনি শত ব্যস্ততার মধ্যেও যে কাজটা করবেন মনে করেন, তা-ই করতে পারেন। তা হলে ব্যস্ত কথাটা আর বলি কীভাবে?
মুম্বাইয়ের সঙ্গীতজগতে এই মুহূর্তে জিৎ গাঙ্গুলি একটা নাম। এর আগেও কিশোরকুমার, সলিল চৌধুরী, বাপ্পী লাহিড়ি, কুমার শানু, এই প্রজন্মের শ্রেয়া ঘোষাল, অরিজিৎ সিং... বাঙালির একটা গ্লোরিয়াস রিজেন্ট রয়েছে। মানে বাঙালি সর্বত্র হার মানলেও, সঙ্গীত জগতে কিন্তু তোমাদের মতো লোক থাকাতেই এগিয়ে গেছে অনেকটা। এটা কীভাবে সম্ভব?
কারণ আমার মনে হয় বাংলার সংস্কৃতি এবং বাঙালির গানবাজনা...আমরা যেটা খুব বেশি দেখেছি। আমরা কলকাতায় বড় হয়েছি। ধরো শ্রেয়া অতটা কলকাতায় বড় হয়নি এবং শানও অতটা কলকাতায় বড় হয়নি, কিন্তু ওদের জিনে আছে, মানে ওদের বাবা-মা। যেমন শানের বাবা ছিলেন মানস মুখোপাধ্যায়। মানস জেঠু কলকাতার ষষ্ঠীতলায় থাকতেন। ওর তাই জিনে রয়েছে। কলকাতায় যত বাঙালি আছে, তাদের ঘরে তুমি হয় হারমোনিয়াম নয় তবলা, না হলে গিটার বা সেতার বা সরোদ কিছু না কিছু পেয়ে যাবেই। এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তাই সঙ্গীতে মা সরস্বতীর একটা কৃপা আছে প্রত্যেকটা বাঙালির উপরে। না শুধু গানবাজনাই বলব না, তার সাথে আবৃত্তি আছে। মানে যাঁরা মিউজিশিয়ান, সেতার বাজান, সরোদ বাজান, তবলা বাজান...তাঁদের প্রত্যেকের ওপরেই আছে। সেটা ক্লাসিক্যাল হোক বা তোমার ফিল্মি মিউজিক হোক, ডান্সিং মিউজিক বলো...সবেতেই। আর সবচেয়ে বড় যে কথাটা বলতে চাই, তা হচ্ছে... সবার ওপরে রয়েছেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ। ওঁর ইন্সপিরেশন। আমার ছেলেবেলা কিন্তু শুরু হয়েছিল ওঁরই গান দিয়ে... এবং আমার মতো শত শত, হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ বাঙালির শুরুর রুট মনে হয় এটাই। এই রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়েই সব শুরু হয়েছে। এই সুর, তার ভাব ও কালচার একেবারে জিনের মধ্যে ঢুকে গেছে।
ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া মানুষ বিপদে পড়ে না। মনে করে জিৎ। তার মতে—বিপদ থেকেই আসে কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা।
আমার জার্নিটা খুব ভাল ছিল না। আমি হচ্ছি আঠেরো পুরুষ, যারা মিউজিকের মধ্যে আছি। আমার বাবা সেভেনটিনথ জেনারেশন, তার পর আমি। আমার দাদু ক্ল্যাসিকাল গাইয়ে ছিলেন। তার আগে প্রপিতামহ সেতার বাজাতেন। এ রকমই চলে আসছে। গোটা পরিবারটাই সঙ্গীতের সঙ্গে...এবং আমার মা। তিনিও খুব ভাল গান গাইতেন। আমার মা মীনা গাঙ্গুলির অনেক রেকর্ড আছে, তখনকার দিনের রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ক্লাসিক্যাল। আধুনিকও গাইতেন কিছু কিছু। তো, এই যে আমার জন্ম হওয়ার পর থেকেই, মানে বলতে পারো মাতৃগর্ভ থেকেই আমি শুনে আসছি বাড়িতে গানবাজনা, রিহার্সাল সমস্ত। কেননা যখন আমার জন্ম হয়, তখন থেকেই আমি বাড়িতে একটা করে ইনস্ট্রুমেন্ট দেখে যাচ্ছি। এর পর আমার শুরুটা এভাবে হয় যে... আমার যখন একেবারে ছোট বয়স, তখন একটু হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে হারমোনিয়ামটা প্যাঁ করে বাজিয়ে আসতাম...তবলাটা দুম করে একটু বাজিয়ে এলাম...এভাবেই শুরু হয়। বাড়িতে যারা রিহার্সাল করত, আমার বাবা-মা দুজনেই বলেছে, তারা আমাকে ভয় পেত রীতিমতো। কেননা ইনস্ট্রুমেন্ট খুলে রাখলেই আমি ওখানে গিয়ে হামলা করতাম। আর একটা কথা বলি। মার থেকে শুনেছি, আমি ঘুম থেকে ওঠা মাত্রই কিছু না কিছু শুনতে চাইতাম। সেটা রেডিও হোক বা রেকর্ড প্লেয়ার হোক বা যা-ই হোক! তখন রেকর্ড প্লেয়ার ছিল, এখনও সেটা আছে। আজও রোজ ওটা শোনা চাই আমার। কি বলব তোমাকে। পাঁচ মিনিট হলেও কিছু একটু শুনব আমি। কিন্তু সেটা কখনওই নিজের গান হবে না। মানে নিজের গান কোনও দিন শুনব না আমি! সারা বিশ্বের মিউজিক যা কিছু হয়... পাঁচ মিনিট অন্তত শুনে নিই! আমার দারুণ পছন্দের মানুষদের গান শুনি। লতাজির গান, মহম্মদ রফি সাবের গান, কিশোরমারের গান স্রেফ পাঁচ মিনিট শুনে নিলাম। মনটা শান্ত হয়ে গেল।
তো, এ ভাবেই শুরু হয় আমার মিউজিকের জার্নি। কিন্তু মাঝখানে মামা আমাকে নিয়ে গ্ৰুপ থিয়েটারে যেতেন, থিয়েটার করা আরম্ভ হয়েছিল। সেটা কিন্তু আমি বলছি ফিফথ স্ট্যান্ডার্ড বা সিক্স স্ট্যান্ডার্ডে যখন পড়ি, তখনকার কথা। আমি মামার সঙ্গে যেতাম গ্ৰুপ থিয়েটারে। কি জানি কেন, আমার খুব ভাল লাগত। অনেক ড্রামা আমি নিজেও করতাম। এটা হতে হতেই স্কুল ও পাড়ার ক্লাবগুলোতে সেখানে নাটক হত, হঠাৎ হঠাৎ একটা সুর করে ফেলতাম বা অন্য কিছু। সুর করার ব্যাপারটা তাই ছিলই।
কি রকম?
আমি বলছি ক্লাস ফোর, ফাইভে পড়ার সময় আমি নিজে নিজে গান করতাম। বাবা একদিন ও সব শুনে বলল— এ গান তো আমি কোনও দিন শুনিনি। মাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কী বানাচ্ছে ও? শুনে মা বলল, হ্যাঁ, প্রায়ই তো কিছু না কিছু গাইতে থাকে। বাবা তখন বলল, এক কাজ করো। ওর জন্মদিন আসছে। ওর জন্মদিনে একটা টেপরেকর্ডার কিনে দাও। তো সেবার জন্মদিনে একটা টেপ রেকর্ডার কিনে দিলেন ওরা। আর বাবা, মাকে বুঝিয়ে বলে দিল, যখনই দেখবে ও নতুন কিছু গাইছে, তুমি সঙ্গে সঙ্গে ওটা রেকর্ড করে রাখবে। আর আমি যখন ফ্রি হব, তখন একবারে সব শুনব, কি গাইছে ও।
তো বাবা ও রকম করে শুনে মাকে বললেন, ও কিন্তু কম্পোজ করতে পারে, ওর একটা ন্যাক আছে। মানে এটা আমি নতুন শুনছি ওর কাছ থেকে। তার পর বাবা আমায় অনেক কিছু শুনিয়েছেন। ভেঞ্চার থেকে নিয়ে ওয়েস্টার্ন, ক্লাসিক্যাল, বেঠোফেন... সব! ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যালও শোনাতেন, ওই যে তোমায় বললাম রেকর্ড প্লেয়ারে সব শোনা। তার পর আমি যখন সিক্সথ কি সেভেনথ স্ট্যান্ডার্ড... হঠাৎই একটা নাটকে সুর করার সুযোগ আসে আমার। সেটি ছিল ‘সত্যি ভূতের গপ্পো’। তার টাইটেল সং আমাকে গাইতে বলা হয় এবং আমি গানটা বানিয়ে ফেলি। এখন আমি তোমায় দু’লাইন শোনাচ্ছি গানটা... এক সময়ে যা ছিল ‘সত্যি ভূতের গপ্পো বলি শোনো শোনো’। সেটাই পরবর্তী কালে কথা পাল্টে হয়ে দাঁড়ায় ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে খুশিতে নাচে মন’। দ্যাখো, এই আমার ছোটবেলায় হঠাৎ করে ফেলা সেই সুর! আমি জানি না কীভাবে হয়েছিল। এ তো মা দুর্গারই আশীর্বাদ। যখন ২০০৮-এ ‘পরান যায় জ্বলিয়া রে’-র ফ্রেমটি হচ্ছে, মা দুর্গার সামনে গান করার সিন। আমাকে রবি কিনাগি বলেন যে... জিৎ, একটা গান চাই আমি। মা দুর্গার ওখানে গান হচ্ছে, যেখানে দেব ও শুভশ্রী পারফর্ম করবে এবং বাড়ির সবাই থাকবে... মানে একটা পারিবারিক গান হবে। এই প্রথম দুর্গার গান হবে। তুমি করো। আমি গিটার নিয়ে বসে আছি... হঠাৎ সামনে এল সুরটা... আমি জানি না, কি করে এল ব্যাপারটা। কিন্তু আমার মাথায় ওই সুরটাই এল ... না-না-না-না, না-না-না-না, না-না, না-না!
তো, এই ভাবে আমার জার্নিটা শুরু হয়েছে এবং হয়ে চলেছে আর কি! এমনই অনেক ছোটবেলার গান এখনও আমার আছে, যেগুলো আজও রিলিজ করা হয়নি। সেগুলো ডেফিনিটলি আমি রিলিজ করব। তো এইভাবেই আমার জার্নিটা শুরু হয়... এবং তা একেবারেই কলকাতায়।
একটু কিন্তু বড় হবে দাদা। এখন শান্তিনিকেতন- কে সবটা জানালে প্রবলেম নেই তো?
না না, ভালই তো। হোক না বড়। জিৎকে কে-ই বা এতটুকু পেতে চায়?
না না, সে রকম কিছু না! জার্নিটার মাঝখানে সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল। কেন আমি বলি। আমার বাবার একটা খুব বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয় এবং ওর দু’পায়ের ওপর দিয়ে ডবল ডেকার বাস চলে যায়। যেটা আমার জীবনে একটা সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। আমার এবং আমার পরিবারের কাছে একটা বিশাল আঘাত। আমার মা শক্ত হাতে সে দিন যদি সব কিছু হ্যান্ডল না করতেন, তা হলে আজ আমি এ জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না। অল ক্রেডিট গোজ টু মাই মামি! বাবা পিজি হাসপাতালে ছিলেন এক বছর তিন মাস এবং সেটা তখন অনেক কঠিন পরিস্থিতি... কেননা মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট তখনও এত ডেভেলপড হয়নি। সত্যি বলতে কী, বাবার প্লাস্টিক সার্জারি! তখন এক নতুন টার্ম!
কোন সাল হবে তখন?
এই ৮৩-৮৪। সে সময়ে খুব ছোট আমি। হ্যাঁ, ঈশ্বরই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বাবাকে। যদিও অল ক্রেডিট গোজ টু মাই মাদার। ওই পিজি হাসপাতালে আমার মায়ের নামই হয়ে গেছিল ‘সীতা মা’। মানে এতটাই সেবা করেছিলেন বাবাকে। এটা আমার নিজের চোখে দেখা এবং সেই কষ্টের কথা বলে বোঝাতে পারব না। একটা কথা আজ আমায় বলতেই হবে: জীবনে যখন কষ্ট আসে, জীবনে যখন স্টাগল আসে, আমাদের ভয় হয়। সেটা কিন্তু আসলে ঈশ্বরের ব্লেসিংস। মানে এই কষ্টটা যদি না আসত, হয়তো ভাল কিছুই ঘটত না। এটা আমার জীবনে একটা বিরাট উপলব্ধি। মানুষের জীবনে এমনই একেকটা টার্নিং পয়েন্ট আসে, যখন আমরা ভাবি... ভগবান! আমার জীবনে এটা কী হয়ে গেল? কিংবা ভগবান কেন যে এমনটা করলেন? সেটা অবশ্য পরে ঠিকই বোঝা যায়।
ওই যে শুরুটা হল, মানে স্টাগল করার শুরুটা... আমি বলি তোমাকে, আমার একটা সময় গেছে যখন বন্ধুর থেকে বই ধার করেই আমায় পড়াশোনা করতে হয়েছে! আসলে আমার বাবা সারাজীবন গানবাজনার মধ্যেই ছিলেন। উনি অন্য কোনও কাজ করতেন না। একটা সময় গেছে, যখন আমাদের বাড়িটাড়ি সব বিক্রি হয়ে যায় একমাত্র বাবাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আমার মাকে চাকরি নিতে হয়েছে আয় করার জন্য...এমন সময়ও গেছে। তোমার মাধ্যমে এ কথা আজ কেন বলছি? বলছি এ জন্যই...যারা জানায় না যে স্ট্রাগল করেছে বা করছে, তাদের এটা শোনা উচিত। স্ট্রাগল করা কিন্তু সুযোগ পাওয়ার জন্যই খুব দরকার। স্ট্রাগল করার সুযোগ পাওয়া তাই খুব বড় কথা। অনেকে স্ট্রাগল করার সুযোগ পায় না। সেটার জন্য সব সময়েই আমি ঈশ্বরের কাছে খুব কৃতজ্ঞ! জানো তো, আমি সুযোগ পেয়েছি স্ট্রাগল করার। আমি দেখেছি, এই স্ট্রাগলটা কি করে আসে! কোথায় আসে! যে কোনও দিক থেকে আসবে, কিন্তু তোমায় তা কেটে বেরোতে হবে! তুমি জানো, একটা সময়ে বাবার ব্লাড কিনতে গিয়ে বাবার সবথেকে প্রিয় ইনস্ট্রুমেন্টটা মা ও আমাকে বিক্রি করে দিতে হয়। এটা কত বড় যন্ত্রণাদায়ক, তুমি চিন্তা করো।
বাবার চোখের সামনে তাঁর ইনস্ট্রুমেন্ট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! তাঁর হাতের ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাকর্ডিয়ান! আমার বাবা বাজাতেন এবং শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের বহু শিল্পীই বাবাকে চেনেন এবং ওঁর বাজনা এখনও বরাহনগরের আদি বাসিন্দারা সকলেই জানেন। আমার জন্মও কিন্তু ওই বরাহনগরেই। আমার বাবার একটা গুণের কথা বলি তোমাকে। আমরা তো গান করি, তাই কখনও কখনও গান করে বা কথা বলেও আমরা দর্শকের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করি। আমর বাবা অর্কেস্ট্রার মতো ইনস্ট্রুমেন্ট বাজিয়ে তখন লোককে মাতিয়ে দিতেন। তাঁর হাত কথা বলত। এটা অনেকেই জানেন যে তা খুব কঠিন কাজ। অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে মানুষের মন জয় করা, যেখানে কোনও লিরিক্স নেই। তুমি ভেবে দ্যাখো তো, অত বড় একজন শিল্পীর দেড় বছর ধরে হাসপাতালে শুয়ে থাকা! ওঁর ওপর কত বড় একটা ডিপ্রেশন চলে আসছিল। এ দিকে দেখতে দেখতেই আমি তখন নাইন, টেন... মাধ্যমিকের ওই সময়টায়। আমার বাবা জিজ্ঞেস করছেন, কী করবি বল তো?
সঙ্গীতজগতে মারাদোনা না হয়ে... ফুটবলেও মারাদোনা হতে পারত জিৎ গাঙ্গুলি!
আমি ফুটবলও খেলতাম। আমার দাদামশাই বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক গোপাল মুখোপাধ্যায়। উনি খেলার মাঠে সেই সময় দাপিয়ে বেড়াতেন। দাদুর সঙ্গেই আমার খেলার মাঠে যাওয়া এবং প্রচুর জায়গায় আমি খেলেছি। জুনিয়র মোহনবাগানেও। এই সব করে বেরিয়েছি আমি দাদুর সঙ্গে। তখন এমন একটা পরিস্থিতি যে, বাবা জিজ্ঞেস করলেন এখন তুই কি করবি বল তো? তোর মায়ের ঘাড়েই সবটা পড়ে গেছে। আমর মার তখন চাকরি নেই, আমাদের চলবে কি করে? তো আমি তখন বললাম যে, বাবা, আমায় তো কিছু করতেই হবে। শুনে বাবা বললেন, তুই খেলবি? না কি গানবাজনার দিকে যাবি? আমি এক দিন সময় নিয়েছিলাম বাবার থেকে। বললাম যে, বাবা আমাকে একটা দিন সময় দেবে?
ওই একটা দিনেই জীবনের অনেক বড় ডিসিশন নিতে হবে। তখন আমি ক্লাস নাইন শেষ করে টেনে উঠব। আমি বাবাকে বললাম, আমি গানবাজনা করব। আমি আর খেলাধুলা করব না। শুনে বাবা বললেন, ভাল করে ভেবে দ্যাখ। দুটো কিন্তু একসঙ্গে হয় না। তাই তোকে জিজ্ঞেস করছি। আমি বললাম, বাবা আমি গানবাজনা করব। এটা আমি বলেছিলাম দুটো কারণে। একটা তো সে সময়ে আমার ইচ্ছা ডেফিনিটলি মিউজিক ডিরেক্টর হওয়ার। ওটা প্রথম থেকেই ইচ্ছা ছিল। তোমায় আগেই বলেছি, সুর করার একটা প্রবণতা ছিলই। সব কিছু তখন আমি বাবাকে বললাম। বাবা বললেন, গানবাজনা করবে না কি অন্য কিছু? আমি বললাম, বাবা আমি মিউজিক ডিরেক্টর হতে চাই। বাবা বললেন, অনেক বড় শব্দ এটা! মিউজিক ডিরেক্টর হওয়া সোজা কথা নয়। তখন আমার বাবা, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আর ডি বর্মন, এস ডি বর্মন...এঁদের নাম করতে করতেই বললেন যে, এঁরা কত কী শিখে তার পর এই জায়গায় এসেছেন! ফলে তোমাকে প্রচুর মেহনত করতে হবে আর বহু কিছু শিখতে হবে! ইনস্ট্রুমেন্ট শেখা আছে... আরও অনেক কিছু আছে।
তখন কি উত্তর ছিল জিতের?
আমি বললাম, হ্যাঁ বাবা আমি শিখব। এবার দেখো, এর মধ্যে কিন্তু আমার একটা চিন্তা ছিল। কী চিন্তা ছিল, বলো তো? আমি যদি একটা ইনস্ট্রুমেন্ট বাজাই, আমি সেটার একটা সঙ্গত করতে পারব । সঙ্গত করলে কী হবে? রোজগার করতে পারব। তাই সঙ্গত করা মানে তবলা বাজাচ্ছে কেউ, সেতার বাজাচ্ছে কেউ, কেউ পিয়ানো বাজাচ্ছে, কেউ গিটার বাজাচ্ছে, কেউ হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে, তারা সঙ্গত করছে একজন আর্টিস্টকে। আমি ভাবলাম, আমি যদি কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট বাজাই, তা হলে আমি আমার মাকে সংসারেও সঙ্গত করতে পারব। তাই আমি বাবাকে বললাম। তো বাবা বললেন, কী ইনস্ট্রুমেন্ট শিখবি? আমার গিটার বাজাতে খুব ভাল লাগে। মানে আমার গিটারটা খুব ফেভারিট ইনস্ট্রুমেন্ট। বাবা বললেন, ঠিক আছে। যদি গিটার ধরিস, তা হলে ফুটবলটা কিন্তু একেবারে বন্ধ। আর মাঠে যেতে পারবে না। একটা দিনও না। আমি বললাম, হ্যাঁ। দেখতে দেখতে মাধ্যমিক এল। আমার কাছে প্রথম দেড়শো টাকা দামের একটা গিটার আসে। যেটি হাওয়াইয়ান গিটার, মানে আমরা যেমন বার দিয়ে বাজাই, তেমন না। দুটো গিটার আছে একটা স্প্যানিশ গিটার আর একটা হাওয়াইয়ান গিটার। ওই হাওয়াইয়ান গিটারের মতো একটা গিটার পেয়েছিলাম ১৫০ টাকার মধ্যে ।আর কিছু কুলায়নি। আমার বাবার বন্ধু শরৎকাকুর সিঁথির মোড়ে গিটারের একটা ফ্যাকট্রি ছিল এবং ওখান থেকেই আমি গিটার নিয়ে আসি।
কমদামি গিটার বাজাতে গিয়ে আঙুল কেটে কী রক্ত! তবুও চলছে চর্চা। সেই গিটারের সেটিংটা অনেক ওপরে এবং যেই প্রেশার দিতাম, অমনি আমার হাত দিয়ে রক্ত বেরোত। মানে এ রকম পরিস্থিতিতে আমার গানবাজনা শুরু হল আর কি। মানে এ বার ওই গিটার ট্রেনিং। তার পর আস্তে আস্তে আস্তে আমার স্যারের কাছে যাওয়া। কার্লটন কিটো স্যারের কাছে বাবা আমাকে পাঠালেন গিটার শেখার জন্য। এই শেখার পর মনে হল, আমাকে পরিশ্রম করতে হবে। ১২-১৪ ঘণ্টা গিটার বাজাতাম তখন আমি। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর... তুমি তো জানোই... তখন তিন মাসের একটা গ্যাপ থাকত।
হ্যাঁ। রেজাল্ট আউট হওয়ার আগে।
সেই তিন মাস সময়টা আমি ওয়েস্ট করিনি। মানে দিন রাত এক করে প্র্যাকটিস করে গেছি। আমি যখন ইলেভেনে... মানে মাধ্যমিক পাশ করলাম, তখন আমার একটা গিটার কেনা হল এবং সেটি প্রথমে বাকিতে নিয়েছিলাম। বাগবাজারে হাক রায়ের দোকান থেকে। এই গিটারটা আসার পর আমি শুরু করলাম সঙ্গত করা। এবার আমি তোমায় বলি, এক এক করে সবার সঙ্গে সঙ্গত করতে করতে আমার কিন্তু কান তৈরি হচ্ছিল। আমার লক্ষ্য তো মিউজিক ডিরেক্টর হওয়ার। কিন্তু ওই যে এত মানুষের সঙ্গে সঙ্গত করতে করতেই আমার সুযোগ হল রেডিওতে। রেডিওতে খুব অদ্ভুত ভাবেই সঙ্গত করার চান্স পেয়েছিলাম। তা, ওখানে একটা ডিউটি চার্ট হত, জানো তো? মিউজিশিয়ান যাঁরাই রেডিওর কাজ করেন বা সঙ্গত করেন, তাঁদের ডিউটি পুরো দিনের। মানে প্রায় সকাল ৮টা থেকে শুরু করে একেবারে রাত ৮টা অবধি। সেখানে যত শিল্পী আসেন, তাঁরা বেতারের নিয়মিত শিল্পী। তাঁদের সাথে সঙ্গত করতে হবে। এটা খুব টাফ। ওখানে একটাই মাইক, তাই ভুল করলে খুবই খারাপ ব্যাপার আর কি। একবার তালিম, তার পরেই ফাইনাল রেকর্ডিং। তা, এখানে শিল্পীর নামের তালিকাটা প্রথম যখন দেখলাম, আমার গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। প্রথম দিনের প্রথম শিল্পীই হচ্ছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তার পর মান্না দে, তার পর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়... এই মাপের শিল্পীরা সব আসছেন আর আমি বাজিয়ে যাচ্ছি ওঁদের সঙ্গে।
এটাকে তুমি কীভাবে দেখো?
কিছুক্ষণ আগে তোমাকে একটা কথা বলেছিলাম যে... মানুষের হয়তো মনে হবে, এই পরিস্থিতি কেন হল? যেমন আমার অত খারাপ পরিস্থিতির জন্য আমি বাজনা ধরলাম। তার পরে এই মানুষগুলোর সান্নিধ্যে এলাম। আমার কানে সুর ঢুকতে আরম্ভ করল। নতুন নতুন সুর। আমার সুর করার তাগিদটা বেড়ে গেল আরও। তাই বলছিলাম যে, এই যে স্ট্রাগল করার সুযোগটা ঈশ্বরই আমায় দিয়েছেন আর সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ ঈশ্বরের কাছে। আর এই করেই আমার জার্নি শুরু হয়। তার পর ১৯৯৬-এ অনুপ জলোটার সঙ্গে আমার দেখা হয়...আর ওঁর হাত ধরেই মুম্বইয়ে গাইতে আসা। তো এইভাবেই চলতে থাকে একটু একটু করে আমার জার্নি।
জার্নি বললাম বটে, তবে পুরোটা নয়। আমার সত্যিই এটা দুর্ভাগ্য যে, আমি কিশোরদার সঙ্গে কাজ করতে পারিনি, মহম্মদ রফির সঙ্গে কাজ করতে পারিনি। তখন তো তাঁরা ছিলেন না। আমি যখন গেছি ’৯৬ সালে, তখন পঞ্চমদাও চলে গেছে। তো আমি বম্বেতে যখন এলাম তখন মেনলি আমি সঙ্গত করতাম। অনুপজি তো ছিলেনই... হরিহরনজি, গুলাম নবি খান সাব... এঁদের সঙ্গে আমি প্রচুর সঙ্গত করেছি। পাশাপাশি আস্তে আস্তে অ্যাড করতে আরম্ভ করলাম। হিউজ স্ট্রাগল বলতে পারো। তার পর সিরিয়ালের টাইটেল সং প্রচুর করেছি। তার পর আস্তে আস্তে ফিল্ম শুরু হল। মেরে ইয়ার কি শাদি মে, তেরে লিয়ে। এগুলো হওয়ার পর ২০০৪-এ হঠাৎ একদিন আমি পুজোর সময় কলকাতায় আসি।
দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে বাংলা গান উধাও, হিন্দির রমরমা। তখন বাংলা গানকে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ফিরিয়ে আনতে জুড়ি নেই জিতের।
মাঝে মাঝেই আসতাম। কিন্তু দুর্গাপুজোয় কোনও দিন আসা হত না। সে বার যখন এলাম, দেখলাম দুর্গাপূজোর প্যান্ডেলে বাংলা গান বাজছে না! আমাদের ছোটবেলায় প্যান্ডেলে যাওয়া মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গান, লতাজির পুজোর গান, আরতি মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গান... এ সব গান প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজত ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী জুড়ে! নয়তো আর ডি বর্মন, আশা জি এই সব চলত।
কিন্তু আনফরচুনেটলি আমি গিয়ে দেখলাম, ২০০২-২০০৩ সালে এখানে রমরমিয়ে হিন্দি গান বাজছে, ইংরেজি গানও বাজছে। কিন্তু বাংলা গানের কোনও চল নেই। আমার বন্ধুবান্ধব বলল, বাংলা গান তো চলেই না, পুজোতেও আর শোনা যায় না। এই একটা আঘাত আমি পেলাম! জেদ চাপল এটা ভেবে যে, ছোটবেলা থেকে আমি এখানে বড় হয়েছি, সমস্ত কিছু করেছি... বাংলা গান আমাকে খাইয়েছে, বাংলা গান আমায় শিখিয়েছে... সেই বাংলা গান হবে না মানে? তখন মনে একটা জেদ ঢুকল। আমি বাবাকে বললাম, বাবা এটা কেন হবে? বাবা বলল, দ্যাখো, তুমি কম্পোজ করছ, করো। যেখানে থাকছ, থাকো। কিন্তু বাংলায় তুমি জন্মেছ, বাংলার জন্য কী করবে, এটা আগে ভাবো। এবার তোমাকে বাংলায় কাজ করতেই হবে। তখন আমার প্রথম ছবি ছিল ‘প্রেমী ২০০৪’। যেখানে জিৎ এবং চন্দনা ছিল এবং রবি কিনাগি ছিলেন পরিচালক। তো এই ছবিটা সুন্দর হল, মিউজিক আরম্ভ হল। কিন্তু দাদা, আমার মাথায় মধ্যে কেমন ঢুকে গেল যে, বাংলা গান ডিস্কে বাজতেই হবে, বাংলা গান পুজো প্যান্ডেলে বাজবেই বাজবে, বাংলা গানকে সর্বজনীন করতে হবে। আর জানো তো, তখন দেখতাম... বাংলায় প্রচুর লোক কাজ করতে এলেও তারা সমানে বলত, বাংলা ছবি আবার চলে নাকি? বাংলা গান সেভাবে আর হয় নাকি? খুব খারাপ লাগত শুনতে। আমি তোমায় বলছি, এখন তারাই বাংলা ছবিতে এসে কেউ ডিরেক্টর, কেউ মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছে! অথচ তারাই আমাকে এই কথাগুলো বলত।
জিতের এই লড়াইয়ে সঙ্গী মনের শক্তি আর অর্ধাঙ্গিনী চন্দ্রাণী
সত্যিই এখানে আমায় সবচেয়ে বড় সাহস জুগিয়েছে চন্দ্রাণী। চন্দ্রাণী না থাকলে এই যাত্রাটা কী হত, আমি জানি না। মানে আমি তোমায় বলি, ২০০৪-এ যখন আমি বাংলায় কাজ করতে আসি, তখন বাংলা গানের রেমুনারেশন ছিল খুবই কম। এ দিকে বম্বেতেও আমাদের স্ট্রাগল চলছে। বিশাল কিছু নেই তখন এই বাংলা গানে। কিছু ফিল্মের কথা বলছি তোমায়... ‘শুভদৃষ্টি’, ‘বন্ধন’, ‘যুদ্ধ’, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’। আইকনিক অ্যালবাম সব! ‘মন মানে না’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘পরান যায় জ্বলিয়া রে’... এই ছবিগুলো যখন মিউজিক হচ্ছে, শুনুন দাদা, আমার মধ্যে একটা পাগলামি আছে... যদি আমার মনে হয় যে, এই গানের মধ্যে এই ইনস্ট্রুমেন্টটা দরকার, আর তা এই লোকটাই বাজাবে... আমার তখন তাকেই চাই! বাবা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, কিছু করার নেই! আমি সেটা ছাড়া কম্প্রোমাইজ করতে পারব না। আমার যা কিছু হয়ে যাক, তা মেনে নেব... কিন্তু আমি কম্প্রোমাইজ করতে পারব না। তখন বাংলায় মিউজিশিয়ানদের এই সামান্য পেমেন্টের জন্যই আমার কাছে তেমন পয়সা ছিল না দাদা। চন্দ্রাণী কলেজে পড়ায়... সেই কলেজে পড়ানোর টাকাতেই ভাগ বসিয়েছি। তোমায় সত্যি কথা বলছি।
0 Comments