কালাপানি পেরিয়ে তীর্থস্থান


শাশ্বতী পাল চৌধুরী

সেই কলেজ জীবন থেকে আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে সেই কালাপানি পেরিয়ে আন্দামান-নিকোবর। পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে ওই দ্বীপপুঞ্জের প্রতি এত টান জন্মানোর কারণ যেখানে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গলের সঙ্গে প্রাচীন জনজাতির ইতিহাস আছে, সঙ্গে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।

ইতিহাস যেখানে আনাচে কানাচে উঁকি মারে, সমুদ্র যেখানে হিপনোটাইজ করার এক সাংঘাতিক ক্ষমতা রাখে সেখানে যাওয়ার সুযোগ তো সবসময় হয় না। এই বছর সেই সুযোগ এসেছিল, সপরিবারে আন্দামান বেড়াতে যাওয়ার। আন্দামান মানে ঝড়-ঝঞ্ঝা এবং গরম, যার কথা মাথায় রেখে সবসময় যাওয়া উচিত।

নিরক্ষীয় অঞ্চলে গরমকালে কখনও যাওয়া উচিত নয়। তারপর কালবৈশাখী এবং আশ্বিন মাসে আশ্বিনের ঝড়ের কথা বাদ দিলে শীতকালই আন্দামানের সেরা সময়। পোর্ট ব্লেয়ারে একেবারে ধারে সমুদ্রের কাছে রামকৃষ্ণ আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা হল আমাদের। আশ্রম থেকেই বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে ওদিকে নর্থ বে। রসদ্বীপ তো আশ্রম থেকেই দেখা যায়। আমরা সৌভাগ্যবান ২৬/১২/২০২৪ থেকে ৫/১/২০২৫ এই ৯ দিনের মধ্যে একদিন সামান্য বৃষ্টি পেয়েছিলাম, ঝড় হয়নি একদিনও।

যে জারোয়া, ওঙ্গে, নিকবোরীজ প্রভৃতি জনজাতির জন্য আন্দামান বিখ্যাত তারা কেউই কিন্তু প্রধান দ্বীপ পোর্টব্লেয়ারে থাকে না। পোর্টব্লেয়ার বিখ্যাত অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য, সামুদ্রিক সংগ্রহশালা, প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা আর সেলুলার জেলের জন্য। আমাদের কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং জলচর প্রাণীদের প্রদর্শনী দেখলে এখানকার প্রদর্শনী কারুরই আহামরি কিছু লাগবে না। কিন্তু আমার আন্দামান দর্শন সার্থক হল সেলুলার জেল দেখে। একটি কেন্দ্রীয় ঘরকে বেষ্টন করে সূর্য রশ্মির মতো সাতটি সারি দোতলা সজ্জিত, ৭৯৬টি প্রকোষ্ঠ নিয়ে এই বিশাল জেলখানাটি তৈরি করেছিলেন ইংরেজরা এবং নাম দিয়েছিলেন সেলুলার জেল। ডাক্তার জেমস প্যাটিশন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাষ্পচালিত জাহাজ সেমিরাসিসে ১০ মার্চ, ১৮৫৮ পোর্ট ব্লেয়ারে আসার পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ১৯৪২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৩-৮৪ বছর এই দ্বীপটি ইংরেজদের অধিকারী ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে এই দ্বীপটি ইংরেজরা বিভিন্নভাবে কাজে লাগিয়েছিল, বিশেষ করে ভারতে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামী অর্থাৎ ইংরেজদের ভাষায় দেশদ্রোহী তাঁদেরকে শাস্তিস্বরূপ এখানে দ্বীপান্তরে পাঠানো হত। ভারতের প্রধান ভূখণ্ড থেকে প্রায় দেড় হাজার কিমি দূরে গভীর এবং উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে এই দ্বীপ থেকে আবার ফিরে আসা তখন ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

তারপরে ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতাও ছিল। কালাপানি পেরিয়ে অন্য জায়গা যাওয়ার অপরাধে হিন্দুরা ধর্মচ্যুত হয়, কুলিন এবং হিন্দু সমাজ তাদের অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করত। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা তাদের প্রথম জেল তৈরি করেছিল ভাইপার দ্বীপে। ভাইপার দ্বীপ ছিল সমুদ্রের শান্ত বলয়ে অর্থাৎ ঢেউ প্রায় নেই বললেই চলে। তাই সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে ছোট দ্বীপ না বলে সমুদ্রের ডুবে থাকা এক পাহাড়ের শীর্ষদেশ বললেই ভাল। এক কিলোমিটারও লম্বা নয় এই রসদ্বীপ। পায়ে হেঁটে এক ঘন্টাও লাগবে না সমগ্র দ্বীপটি ঘুরতে। এত ছোট হলেও এখানে কি ছিল না! ইংরেজ আমলের বলরুম, চিফ কমিশনার হাউস, গভর্নমেন্ট হাউস, চার্চ, হাসপাতাল, বেকারি, প্রেস, সৈন্যদের ব্যারাক ও ইংরেজদের তৈরি দ্বিতীয় জেলখানা। কোনও বন্দি জেল থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে প্রবল স্রোতে তার মৃত্যুনিবার্য। সেই ভয়ঙ্কর রসদ্বীপ এখন কি যে সুন্দর দর্শনীয় স্থান তা বর্ণনা করা খুবই কঠিন। পাশের দ্বীপ নর্থ বে দ্বীপের মতোই প্রচুর নারকেল গাছ, নীল আকাশ, নীল সমুদ্র দিয়ে পরিপূর্ণ যার রূপ অবর্ণনীয়! জলের যে কতরকম রঙ হতে পারে, তা এখানে এসে নীল সমুদ্রের আসা-যাওয়ার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। হালকা নীল, তুঁতে, হালকা সবুজ, গাঢ় সবুজ কিংবা কালো কত যে রঙের খেলা! দর্শকদের জন্য ব্যাটারীচালিত গাড়ি পাওয়া যায়। আর ইতিহাসের চিহ্ন হিসাবে ইংরেজদের প্রমোদ আনন্দের নৃশংসতা এবং প্রতিরক্ষার নিদর্শনগুলি ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক, মুক্তভাবে ঘোরা হরিণগুলি যেকোনও মানুষকে আনন্দ দেবে।

আমার তাদের জন্য দুঃখ হয় যারা আমাদের সঙ্গে আন্দামান বেড়াতে গিয়েও কেবল তীব্র ঢেউ দেখে দুর্ঘটনার ভয়েতে আসার সাহস দেখায়নি। এখন যাঁরা আন্দামানের স্থায়ী বাসিন্দা তাঁদের অধিকাংশই অনেক আগে থেকেই এখানে বসবাস করছেন। তাঁদের পূর্বপুরুষদের শাস্তিস্বরূপ এখানে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়েছিল। এখন আন্দামানের প্রকৃতি ভাগ্যবানের বাসস্থান হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু তৎকালীন অবস্থা ছিল খুবই খারাপ।

সেই প্রসঙ্গে বলতে গেলে আমাদের দেখতে হবে সেই সেলুলার জেল যা ইংরেজ কর্তৃক ভয়ংকর এবং তিন নম্বর জেল। এই জেলে ৭৯৬টি কুঠুরিই শুধু নয় ফাঁসি দেওয়া, চাবুক মারা, ক্ষমতার অতিরিক্ত খাটানোর ব্যবস্থা ছিল, আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়া, হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখা প্রভৃতি কতরকম যে শাস্তির ব্যবস্থা ছিল তার ইয়ত্তা নেই। একমাত্র জীবিত সদস্য হিসেবে জেলের মধ্যে বটগাছটি আজও সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল জেলখানার সাতটি রূপ কেন্দ্রীয় গৃহের দেওয়ালে যেখানে হাজার হাজার বন্দীদের নাম আছে, সেখানে ওই মানুষগুলিকে কম খাবার, কম জলে বছরের পর বছর মাত্র ৭/৪ ফুট গৃহে থেকেছেন এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, মারাও গেছেন বহু মানুষ। অসুস্থ হয়ে মৃতপ্রায় হয়ে গেলেও, তারা মুক্তি পায়নি। গাইডের কাছ থেকে এসব কথাগুলো শুনতে শুনতে এবং লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখে আমার মনে হয়েছে আমরা যারা পরাধীন ভারতের অবস্থা দেখিনি বা স্বাধীন ভারত থেকে দেশের সুযোগ সুবিধা নিয়ে দেশের দুর্নাম করি, বিদেশে চাকরি করতে লোলুপ হই, সবার একবার হলেও এই পুণ্যভূমি মহাতীর্থ সেলুলার জেল দেখা উচিত। উত্তর বে আইল্যান্ড এবং রসদ্বীপ আমরা ছোট মেশিন বোটে করে ১২-১৩ জন গিয়েছিলাম। সমুদ্রের ঢেউয়ের তাণ্ডবে তিনবার মেশিন বন্ধ করতে হয়েছিল। 

যাই হোক প্রতিদিন ঘোরার পর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ মনকে খুব আনন্দ দিত। সমুদ্রের তীর আর নেতাজী পয়েন্ট, যেখানে নেতাজি ভারতের প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, সেইখানে বসে থাকতে থাকতে দেখলাম কিছু দূরে থাকা রস আইল্যান্ডে ৯টায় আলো নিভে গেল, যার রূপে আমি মুগ্ধ। প্রকৃতপক্ষে আন্দামান দ্বীপে বিদ্যুতের জন্য বড় বড় জেনারেটর আছে। 

১৯৪২ সালে নেতাজি ভারতের প্রথম স্বাধীনতার পতাকা আন্দামানে তুলেছিলেন শুধু তাই নয়, এই সেলুলার জেলের বহু বন্দীকে তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন তাই হয়তো তাঁর সম্মানেই বর্তমান সরকার ২০১৮ সালে এই রসদ্বীপটির নাম দিয়েছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র দ্বীপ।

তিনদিন এভাবেই কেটে গেল। এবার এল রামকৃষ্ণ মিশন ছেড়ে হ্যাভলক দ্বীপে যাওয়ার দিন। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে হ্যাভলক (স্বরাজ দ্বীপ)। গাঢ় নীল জলে সরকারি জাহাজে প্রায় পাঁচ ঘন্টার যাত্রা। রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশে জাহাজের ডেকে সবাই মিলে আড্ডা মারতে মারতে চলে এলাম স্বরাজ দ্বীপে। নিচে একটি কেবিনে আমাদের টিকিট ছিল কিন্তু ভাল লাগল না ওখানে বসতে। যাই হোক দুপুরবেলা স্বরাজ দ্বীপে পৌঁছে আমরা সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে মেশিন বোটে চললাম এলিফ্যান্টা দ্বীপে, ওখানে আন্দামানের শ্রেষ্ঠ  সব রাইড যেমন- স্কুবা ডাইভ, গ্লাস বোট, ওয়াটার বাইক, সাবমেরিন রাইড ইত্যাদি। কি অপূর্ব জল দ্বীপ আর যাত্রাপথ! যতই ভাবি স্বপ্নসম লাগে। সাবমেরিন করে জলের নিচে স্বর্গীয় পরিবেশ দেখলাম। রংবেরঙের কোরাল, রংবেরঙের মাছ কাছে জানালা দিয়ে যেন এক স্বপ্নাতুর পরিবেশ। এইসমস্ত রাইডগুলি একটু খরচ বহুল। যেমন জনপ্রতি স্কুবা ডাইভিং-এর জন্য ছ’হাজার টাকা, সাবমেরিন এর জন্য সাড়ে তিন হাজার, গ্লাস বোটে দেড় হাজার টাকা।

তবে শীতকালে আন্দামানের গরমে একটু হলেও কষ্ট হচ্ছিল। আমরা সবাই হারমনি গেস্ট হাউসে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ছিলাম আর পাশে বিশ্বের সপ্তম বিখ্যাত রাধানগর সমুদ্র সৈকত। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলাম এখানে। অনেক বিদেশিকে দেখলাম সমুদ্র স্নান করতে। তাঁরা মূলত সানবাথ নেওয়ার জন্যই এইসময় আসেন। অনেক রাত পর্যন্ত ছিলাম সমুদ্রের ধারে কিন্তু বালি থেকে যে আলোর জ্যোতি বেরনোর কথা শুনেছিলাম তা কিন্তু বুঝতে পারলাম না।

পরের দিন একদম ভোরে বেরিয়ে পড়লাম কালাপাথর সমুদ্র সৈকতের সন্ধানে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! বালির মধ্যে অসংখ্য ভাঙ্গা কোরাল, কেয়া গাছের জঙ্গলের ধারে সমুদ্রের নীল ঢেউ যেন স্বর্গকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে আমাদের মর্ত্যে। এবার আমরা যাব নীল দ্বীপে ম্যাক্রুজে করে।

২ঘন্টা ৩০ মিনিটের যাত্রা; সরকারি জাহাজের মতো এখানে আবার ছাদে ওঠার নিয়ম নেই। জানালা দিয়েই তাই সমুদ্র উপভোগ করলাম। এই দ্বীপে জীবনে প্রথমবার গেলেও যেন মনে হচ্ছে পরিচিত জায়গা। কারণ আমার খুব কাছের দুই বন্ধু তৃষা ও প্রশান্তর বাড়ি। চাকরি সূত্রে ওরা অস্ট্রেলিয়ায় থাকে তবে প্রশান্তর ভাই প্রকাশের আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি ছিল না। আমাদের রাত্রে নৈশভোজ ও সর্বোপরি ডাব খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিল।

ওদের বাগানে আছে কয়েকশত নারকেল গাছ। সমুদ্রের ধার থেকে বিস্তৃত প্রশান্তদের বাগান। প্রকাশ নিজে আমাদের জন্য স্কুবা ডাইভের ব্যবস্থা করেছিল। পরিচিত হওয়ার জন্য টাকাটাও অনেক কমে গিয়েছিল আমাদের। সমুদ্রের মধ্যে সে ভ্রমণ যেন এক সারা জীবনের অভিজ্ঞতা এবং প্রকাশ নিজে আমাদেরকে ন্যাচারাল ব্রিজ ঘুরিয়ে দেখাল। প্রকাশের জন্য বহু বিদেশি এই ন্যাচারাল ব্রিজ দেখতে পায়। এই বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি প্রকাশের কল্পনাতীত। ওর ছেলের আবার আছে এক অদ্ভুত দক্ষতা। নারকেল পাতা দিয়ে এক অদ্ভুত টুপি বানাতে পারে। এই টুপি গরমের মধ্যে যথেষ্ট আরাম দেয়। নীল ওরফে শহিদ দ্বীপটি খুবই ছোট। ৪ কিলোমিটার লম্বা এবং ৮ কিলোমিটার চওড়া। তাই একদিকে সূর্যোদয় অপরদিকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। এখানকার ভরতপুর সমুদ্র সৈকত অনেকটা দীর্ঘ তবে স্বচ্ছজল এক হাঁটু মাত্র। সমুদ্রের প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মিটার নিচে নামলেও এক হাঁটু জলই থাকে। মাত্র দেড় দিন কাটিয়ে প্রকাশদের ছেড়ে নীল দ্বীপ ছেড়ে আসতে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। 

আবার শহিদ দ্বীপ থেকে সরকারি জাহাজে করে সন্ধ্যে ছ’টায় পৌঁছলাম পোর্ট ব্লেয়ারে। এই দিনটা ছিল ২০২৫ এর পয়লা জানুয়ারি। ঠাকুরের কল্পতরু উৎসব। খুব ইচ্ছা ছিল মিশনের আরতির সময় পৌঁছনোর। কিন্তু কিছুটা সময়ের হেরফেরে আমরা পৌঁছাতে পারলাম না। ঠাকুরের প্রসাদ পেয়ে শুরু হল বছরের প্রথম দিনের সন্ধ্যা। 

পরের দিন ঠিক হল আমরাও জারোয়া দেখব এবং লাইম স্টোন গুহা বাড়াটাং দেখতে যাব। রাস্তায় যাওয়ার পথে জঙ্গলে বেশ কিছু জারোয়া ছেলে-মেয়ে মুখে সাদা রং মেখে শুধু প্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। এরপর নদীপথে ৮০০ টাকার যাত্রা। লাইমস্টোন গুহায় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। এইসব মূর্তি আজও তৈরি হয়ে চলেছে। গুহায় যাওয়ার পথটি ম্যানগ্রোভ গাছ দিয়ে ঢাকা। সে এক অপূর্ব অবর্ণনীয় রূপ! মাঝে কয়েকটা কুমিরও দেখতে পেলাম। এরপর আবার জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে মিশন ফিরলাম। পরের দিন সেইভাবে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। চলে গেলাম রামকৃষ্ণ মিশনের পাশে জওহরলাল নেহরু রাজকীয় মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাসবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। উনি আমাদের খুব কাছের বন্ধু। তাঁর গাড়িতে পোর্ট ব্লেয়ার এক চক্কর মারলাম। এখানকার বাজার বিভিন্ন সমুদ্র সৈকত দেখলাম। এখানকার তেলের দাম দেখে আশ্চর্য হলাম। এখানে সমস্ত জিনিসের দাম আমাদের পশ্চিমবঙ্গের থেকে বহুগুণ বেশি। আলু পিঁয়াজ প্রায় ২০০ টাকা কিলো। ছোট একটা মিষ্টি ৫০ টাকা। সেখানে পেট্রোলের দাম মাত্র ৬০ টাকা লিটার। যাই হোক রাত্রে ওদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন আশ্রমে ফিরছি তখন রাত্রি দশটা। সে আর এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! 

আশ্রমের কঠিন অনুশাসন। যথারীতি ঢোকার গেট বন্ধ। কারণ দশটায় ওখানে তালা পড়ে যায়। কি করা যায়! মহারাজকে ফোন, বড় ছাত্রদের ফোন, কেউ ধরল না। শেষে জীবনে প্রথমবার উঁচু পাঁচিল ডিঙিয়ে আশ্রমের মধ্যে এক লাফ। আর কি বলি! ইটের খোঁচা লেগে পা গেল কেটে আর কি রক্ত! ওষুধ দিয়ে ব্যথা থেকে বাঁচলাম। পা ভাঙেনি নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু ভয় থাকল আমার কীর্তিকলাপ সিসিটিভি না ধরে ফেলে। ওই ব্যথা, দাগ ও মনের ভয় এখনও রয়ে গেছে। পরের দিন সকালে বীর সাভারকর এয়ারপোর্টে। সঙ্গে নিয়েছিলাম কিছু কোরাল। 

বৈচিত্র্যময় কোরালগুলোকে ছেড়ে আসতে কিছুতেই মন চাইছিল না। অবশেষে বাংলায় ফিরে আসতে পারলাম কোরালের দেশ থেকে। প্রাকৃতিক সম্পদের আধার আন্দামান যেন চিরকাল এরকম সুন্দর থাকতে পারে আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা যখনই যাবে তখনই যেন এর সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে ফিরে আসে।

Post a Comment

0 Comments