বিষ্ণু ঘোষ
১
রতনপল্লির নিমতলা মাঠ। আজ সন্ধ্যার পর ভিড় জমে উঠেছে। চন্দ্রগ্রহণ। তাই আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ ডেমো সেশনের—টেলিস্কোপে দেখা যাবে গ্রহণের বিস্ময়কর দৃশ্য। দায়িত্বে নিখিলেশ পাল। শান্তিনিকেতনের নিখিলেশদা। যিনি সারাটা জীবন বাড়ি-ঘর ছেড়ে বিজ্ঞানসাধনায় ও নানা প্রদর্শনী করে হৈ হৈ কাটিয়ে দিলেন। অকৃতদার এই মানুষটি নিজে হাতে তৈরি করেন টেলিস্কোপ। সন্ধ্যা থেকেই এখানে একে একে অনেকে জড়ো হয়েছে। আকাশে হালকা মেঘ ভাসছে। তবুও, অনেক প্রত্যাশা ভিড়ের মধ্যে। মাঠে জায়গায় জায়গায় ছোটো ছোটো দলে লোক জড়ো হয়েছে; কারও হাতে শিশিরভেজা ঘাস, কারও হাতে ঠান্ডা বাতাসের কাপে চায়ের উষ্ণতা। মাঠের একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তূর্য। বেশ আরামে সিগারেট ফুঁকছে। বাইরে থেকে শান্ত দেখালেও ভেতরে তার অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে। আজ প্রথমবার সে এমন আয়োজনে এসেছে। অন্যদিকে কিছুটা দূরে, বিশ্বভারতীর কয়েকজন ছাত্রী নিজেদের মধ্যে হাসি-গল্প করতে করতে এগিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত একটি মেয়েকে সে দেখছে, একদৃষ্টিতে। বেশ হাসি-খুশিভাবেই সবার সঙ্গে কথা বলছে। ঠিক যেন অফুরন্ত নদীর মতো। দু’পাড়ে মানুষের সঙ্গে গল্প করতে করতে কলকল বেগে বয়ে যাচ্ছে। অফুরান জল-বাক্য ঢালতে ঢালতে। প্রাণখোলা, অনাবিল আনন্দে মিলে দিচ্ছে নিজেকে। হঠাৎ, কার সঙ্গে যেন দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল। বাবান একদৃষ্টিতে সেদিকেই চেয়ে আছে। দেখছে, ওর চোখে আকাশের দিকে তাকানোর এক অদম্য কৌতূহল। ওর সঙ্গে আরও দুজন বন্ধু। তূর্য এবার চমক ভেঙে হাতে জ্বলন্ত সিগারেটটা ফেলে এগিয়ে যায়, টেলিস্কোপের দিকে, আলেয়ার দিকে। নিখিলেশদা তাকে দেখতে পেয়ে বলে, “আরে তূর্য, তুমি এসেছ! খুব ভালো হল। এসো, এসো। এদিকে এসো। তোমাকে একটু ফোকাসটা দেখিয়ে দিই।” একটু লজ্জা, দ্বিধা কাটিয়ে সে বলে,
“আমি কি এসব পারব, নিখিলেশদা? আমি তো শুধু দেখতেই এলাম।”
“আলবাত পারবে। দেখার সঙ্গে শেখাটাও ফ্রি।” ভীষণ আমুদে মানুষটা এবং ততটাই তার রসবোধ। কী প্রাণোচ্ছ্বল ও অনায়াস তার বাক্যস্ফূর্তি! তূর্য দেখতেই যাচ্ছিল এমন সময় সাদা শাড়ি, কালো ব্লাউজ পরিহিত সেই প্রাণবন্ত মেয়েটি বলে, “নিখিলেশদা, আমাকে শেখান না! আমিও শিখতে চাই।” তূর্য তো পুরো চমকে ওঠে। আদুরে গলায় এমন আবদার! বাপরে, বেলা-অবেলায় কে যেন ডাক দিয়েছে! নিখিলেশদা আবেগী গলায় বলেন, “এসো, এসো। এই তূর্য তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ও হচ্ছে আমার অলিখিত দোসর।” তূর্য তো হতবাক! মনে মনে বলে, “বলে কী, ব্যাটা? ষাটের বয়সের এই তরুণ বলে কী? দোসর? তাও আবার এমন ছলনাময়ী, অপরিসীম চাতুর্যেভরা রমণী! জগতে তো কতকিছুই ঘটে! সব কি আর সম্ভব-অসম্ভবের দাঁড়ি-পাল্লায় মাপা যায়!” প্রাণবন্ত মেয়েটি হো হো করে হেসে ওঠে। অভিমানের সুরে বলে, “ভালো হচ্ছে না, নিখিলেশদা! আপনি কী যে বলেন, না!”
“আরে না, না। তুমি তো আন-অফিসিয়ালি। ও সমস্যা নেই। মজা! দাঁড়াও, পরিচয় করিয়ে দিই। ও হচ্ছে, উদয় মানে আমাদের সবার তূর্য। আর এ হচ্ছে চন্দ্রাণী। বিশ্বভারতী থেকে বাংলায় এম. এ করছে।” তূর্য মজা করেই বলে, “এই চন্দ্রগ্রহণের দিন চন্দ্রাণী!”
“চন্দ্রগ্রহণ তো সাময়িক। আলো কিন্তু চিরন্তন।”
“আমর তো গ্রহণে ভয় নেই, বর্জনেই ভয়।”
“গ্রহণই হল না, এর মধ্যেই বর্জন।” নিখিলেশদা এবার বলে উঠল, “এই ভালো হচ্ছে, কিন্তু। তোমাদের জমবে মনে হচ্ছে। দাঁড়াও, দাঁড়াও আমার আরও দুইজন সখি এসেছে। ওদের সঙ্গেও তোমার পরিচয় করিয়ে দিই।” বলেই, পাশে ডাকেন নিকিতা ও সুমিতাকে। তারাও বেশ সুন্দর। একজন সদ্য কলাভবন থেকে পাশ করেছে। অন্যটি শিক্ষভবনে পড়ছে। এক এক করে সবাই টেলিস্কোপে চোখ রাখছে। কারও বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে আছে, কেউ চুপচাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। শিশুদের হাসি মিশে যাচ্ছে বড়দের ফিসফিসানির ভেতর। নিকিতা ভীষণ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে ওঠে, “ওই দেখো, একেবারে যেন চাঁদ লালচে হয়ে গেছে!” তারা একে একে টেলিস্কোপে চোখ রেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। মনে হয়, চাঁদের ভেতর দিয়ে যেন নিজেরই কোনো গোপন রহস্য দেখা যাচ্ছে। চন্দ্রাণী চোখ সরিয়ে যখন ভিড়ের দিকে তাকাল, তখনই নজরে এল তূর্যকে। লোকজনের ভিড়ে সে একটু আলাদা। নিঃশব্দ, মনোযোগী অথচ চোখে গভীর আলো। এক মুহূর্তের জন্য তারা পরস্পর চোখ মেলাল। চন্দ্রাণীর মনে হল, সময় যেন থেমে গেছে। চারপাশের ফিসফিস, হাসি, নিখিলেশদার গলা–সব মিলিয়ে হঠাৎ দূরে সরে গেল। শুধু সেই দৃষ্টি– যেন আকাশের অন্ধকার ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা এক আলোর রেখা। তূর্যও চোখ সরাল না। তার মনে হল, চাঁদের গ্রহণ আর মেয়েটির চোখ–দুটোই যেন একইসঙ্গে তাকে টেনে নিচ্ছে অচেনা গভীরতার দিকে। হালকা বাতাস বয়ে গেল মাঠ জুড়ে। চাঁদ ঢেকে গেল আরও খানিকটা। আর সেই অন্ধকারে দুজনের চোখের ভাষা হয়ে উঠল একেবারে স্পষ্ট। এমন সময় শব্দ এসে হাজির। শব্দ, তূর্যের বন্ধু। নিখেলেশদারও পরিচিত। বেশ গোছালো ছেলে। সদ্য একটি কলেজে গেস্ট লেকচারার পদে যোগ দিয়েছে। নিখিলেশদার সঙ্গে করমর্দন করে বলে উঠল, “চলো, সবাই একটু চা খেয়ে আসি।” একবাক্যে সক্কলে রাজি। নিখিলেশদা বললেন, “তোমরা যাও, আমি একটু পরেই যোগ দিচ্ছি।” পাশেই কুর্চি। ঠিক হল সেখানেই যাব।
এই দুই দিকের চলাফেরা, হাসি, নিস্তব্ধতা– সব মিলিয়ে রাত যেন আস্তে আস্তে এক বিশেষ দৃশ্যের জন্য সাজতে শুরু করেছে। তূর্য, চন্দ্রাণী, নিকিতা, সুমিতা এবং শব্দ হেঁটে চলেছে। ঠিক যেন আলোর-আঁধারের নিঃশব্দ যাত্রীর মতো। তবে, এখানে নিঃশব্দ নয়– সশব্দে জারিত হয়ে যাচ্ছে এক অপরকে জানা, জানানোর নিত্য-নতুন প্রকরণ ও অভিসন্ধি। কুর্চি নয় –বসা হল অজিতের চায়ের ঠেকে। গোল করে বসেছে সবাই। কোনো গণ্ডগোল নেই। শুধুই হাসি, আড্ডা ও মশকরা চলছে। একেবারে পাশাপাশি তূর্য ও চন্দ্রাণী। গল্প, কথকতা, মজার পরে তূর্য বলে,
“চাঁদের গ্রহণের কালে চন্দ্রাণীর প্রলেপ তখনও ছিল,
আলো আর আলেয়ায় যখন সে জীবন ভরিয়ে দিল।”
সাধু সাধু রবে মুখরিত আড্ডা। চন্দ্রাণী বলল, “বাঃ! অনেক গুণই আছে তাহলে!” তূর্য মজা করে বলে, “সবটাই নির্গুণ।” শব্দ আরও জুড়ে দেয়। বলে, “নির্গুণ ঈশ্বর।” সবাই আবার হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। আড্ডা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। বন্ধুরা কেউ গুণগুণ করে গান ধরেছে। কেউ বা হাই তুলে উঠে পড়ছে। কিন্তু চন্দ্রাণী আর তূর্য যেন অন্য এক নীরব জগতে আটকে গেছে। তাদের দুজনের কথাবার্তা খুব কম। তবু, চোখের ভাষায় যেন অনেক কিছু বলছে।
হঠাৎ জানালার বাইরে সরে যায় মেঘ। চাঁদ পুরোপুরি ফুটে ওঠে। কয়েক ঘণ্টার অন্ধকার ভেদ করে আলো ফিরে আসছে। তূর্য তাকিয়ে থাকে সেই আলোয় ভেজা একটি ফুলের দিকে। চন্দ্রাণী আস্তে বলে ওঠে,
“দেখো, চাঁদটা আবার ফিরে এল। অন্ধকারটা কেবল সাময়িক ছিল।” তূর্য তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, “হয়তো জীবনেরও তাই। কিছু সময় ঢেকে যায়, তারপর আলো ফেরে।” চন্দ্রাণীর চোখে এক মুহূর্তের জন্য গভীর দীপ্তি খেলে যায়। তারা কিছু বলে না আর। শুধু চাঁদের আলোয় ভেসে থাকে সেই নীরবতা। রাত শেষ হয় না। বরং দুজনের মনে এক অজানা সূচনা হয়ে থেকে যায়। ঠিক যেমন চন্দ্রগ্রহণ শেষে চাঁদ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
২
শারদোৎসবের নাটক চলছে। আজকে প্রথম দিন। বাল্মীকি প্রতিভা। পাঠভবনের প্রথম নিবেদন। শান্তিনিকেতনেই পড়াশোনা তূর্যের। অনেক জায়গায় চাকরি করে এখন পাকাপাকিভাবে কাছেই একটা স্কুলে সদ্য চাকরিতে যোগ দিয়েছে। সে শান্তিনিকেতন ছেড়ে গেলেও শান্তিনিকেতন তাকে আর ছাড়ল কোথায়! “আমরা যেথায় মরি ঘুরে/ সে যে যায় না কভু দূরে।” উপাসনা গৃহ থেকে ছাতিমতলা হয়ে রবীন্দ্রভবনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই কথাগুলোই ভাবছিল সে। হঠাৎ, “এই যে, নাটক দেখতে, নাকি?” বলেই পাশে এসে দাঁড়াল প্রাণবন্ত মেয়েটি -চন্দ্রাণী। প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেলেও পরে বলে, “হ্যাঁ। তুমি?”
“আমিও। একবার তো মেসেজ করতে পারতে!”
“হ্যাঁ গো! একদম ভুলে গেছি।” কথাটা বললেও সে জানে, ইচ্ছে করেই এমন করেছিল। আসলে দেখতে চাইছিল! মেয়েটি করে কী! চন্দ্রাণী বলে, “সেই, আমি কেন! তোমার তো কত সখি! সেদিনই দেখলাম।”
“আরে, অনেক সখি থাকলেও রাধা কিন্তু একটাই হয়!”
“বাপরে! কলির কেষ্ট! চলো এখন, চলো। এমনিতেই অনেকটা দেরি করে ফেলেছি। নাটক শুরু হয়ে যাবে।”
“নাটক কি শুরু হয়নি?”
“কোথায়? এখনও পাঁচ মিনিট বাকি। ৭ টা তো!”
“রবীন্দ্রভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে। আজ একটু আগে থেকেই।” এতক্ষণে খেই ধরতে পারে, চন্দ্রাণী। বলে, “এই, এই ভালো হবে না, বলে দিচ্ছি, কিন্তু। চল, আজ হচ্ছে তোমার!”
নাট্যঘরের একেবারে মাঝে এসে বসেছে তারা। আলো হয়ে রত্নাকরের ঠোঁট থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল সুরের প্রথম রেখা। সেটাই ছিল তাঁর নতুন পরিচয়ের সূচনা। অন্ধকার দস্যুর জীবনের মধ্যে প্রথম আলো জ্বলে উঠল–সেই আলো তাদের নিয়ে গেল কবির দেশে, ঋষির পথে। দূর থেকে বনপথে আসা কিশোরীরা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল– ভয়ঙ্কর দস্যু এখন কণ্ঠে তুলেছেন সংগীত। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। তাদের মুখে মঞ্চের আলো এসে পড়ছে হালকা ঝলকানির মতো। শব্দ নেই। শুধু দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু ছন্দ যেন মিলেমিশে যাচ্ছে নাটকের সুরের ভেতরে। চন্দ্রাণী আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে আঁচলে গিঁট দিচ্ছে। তূর্য চুপচাপ তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। কিন্তু চোখের কোণায় সে বারবার খেয়াল করছে মেয়েটির হাসি। তার চোখের ভেতর আলো। খুদে খুদে বাচ্চাদের কী অনায়াস, সাবলীল অভিনয়। তূর্য ভীষণ খুশি হল। ওদের টিচার শর্মিষ্ঠাদি। তূর্যের খুব কাছের। মনে মনে অনেক বাহবা দিল। বেশ অন্যরকম লাগছিল। একেবারে শেষের দিকে চন্দ্রাণী বলল, “তূর্যদা, চলো আজ কোপাই যাব।”
“এখন?”
“হ্যাঁ। আমার খুব ইচ্ছে রাতের কোপাই দেখব।”
“কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু নয়… প্লীজ, প্লীজ!” একটু আবদারের সুরেই কথাটা বলল, সে। এমন করে প্লীজ বললে আর কার, কবে সাধ্যি হয়েছে, না করার। কিন্তু বাবান বেশ পরিচিত এখানে। এমন করে কখনও উঠেও যায়নি। আজ কী মনে হল সে কী আর আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব! উঠেই চলে গেল।
কোপাইয়ের ব্রিজের উপরে পা ঝুলিয়ে বসে গল্প মশগুল। সন্ধ্যার মৃদু হওয়া। একেবারে নিঃঝুম আবহ। পাশে কয়েকটা ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। নিচে কলকল ধ্বনিতে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী –কোপাই। তূর্য অনেকদিন আসেনি, এইদিকে। এমন সন্ধ্যা কাটায়নি বহুদিন। হয়তো চন্দ্রাণীও তাই। বেশ রোমাঞ্চ লাগছে। মন ডুবিয়ে দিচ্ছে নদীর স্রোতে। বাঁচতে ইচ্ছে করছে শুধুই এই মুহূর্তেই। বাকি সব মিথ্যা। সত্যি শুধু কোপাই –এই সন্ধ্যা আর আকাশে চাঁদের আলো। দুটিতে চুপ করে বসে। দেখে কোপাইয়ের বয়ে চলা। এমন সময় চন্দ্রাণী গান ধরে, “অনেক কথা যাও যে বলে/ কোনো কথা না বলি/ তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।”
তূর্য তাকিয়ে থাকে স্থিরভাবে, অস্থির জলের দিকে। চোখে শুধুই মুগ্ধতা ও আলেখ্যমন্দ্রিত স্বপ্ন। আলতো করে চন্দ্রাণী হাত ধরে। নিজেকে ধীরে ধীরে ডুবিয়ে দেয় তূর্যের বুকে। বলে, “যদি কখনও কোনো ভুল করি, ক্ষমা করো, আমায়। জানি না, ঠিক করছি কিনা?” তূর্য আবেশে জড়িয়ে ধরে। বলে,
“বড্ড তাড়াহুড়ো লাগছে। ঠিক-ভুল জানি না। তবে, আমার বেশ ভালো লাগছে। কোনোদিন এমন করে কাটাইনি। সুযোগ এলেও আমি গ্রহণ করিনি, জানিস।”
“আমাকে দূরে ঠেলে দিও না! কষ্ট হবে… হয়তো…” হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে যায়। চোখের ভাষা কথা বলে ওঠে। তারপর খুব ধীরে, নদীর হাওয়ার মতো কোমল হয়ে, তাদের ঠোঁট মিলিয়ে যায়। সেই নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞার সাক্ষী থাকল এই জ্যোৎস্নাভরা রাত, আলো- আঁধারি ব্রিজ ও কোপাই নদী।
বেশ কিছুদিন আবেগমাখা, স্বপ্নের জগতের ফেরিওয়ালা হয় দুটিতে। রতনপল্লি, ভারততীর্থ থেকে শুরু করে বইওয়ালা, সোনাঝুরির রাস্তায় চুটিয়ে ঘোরে। চলে অভিযান, স্বপ্নের বুনন ও অপরিসীম আনন্দের, মুক্তির গল্পকথা। মাঝে- মাঝে আবেগমেশানো অভিমান, ঝগড়া ও একটু-আধটু ভুল বোঝাবুঝিও হলেও মানিয়ে ও মেনে নিয়েছে, দুজনেই। আসলে পুরোটাই এই পালাগানের এক একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। ঠিক যেন পুজোর আগে আকাশ ও রোদের গোপন খেলার মতো। আছে অথচ নেই। শারদোৎসবের নাটকের শেষদিনে ছিল কর্মীমণ্ডলীর নিবেদন ভ্রান্তিবিলাস। সেটা দেখে ফেরে দুটিতে। ঠিক হয় আনন্দবাজারে দেখা হবে। চন্দ্রালোকিত সন্ধ্যায় আড্ডা দিচ্ছে এমন সময় চন্দ্রাণীর ফোন। বলে,
“হ্যালো, শোনো না, অমিত, মানে আমার পিসির ছেলে এসেছে। ও এখন থাকবে। ঘুরবে শান্তিনিকেতন।”
ক্যাজুয়াল সুরেই তূর্য বলে, “থাকবে। অসুবিধা কোথায়!”
“ওর নয়। আমার আছে।”
“কী অসুবিধা?”
“সবটা যদি তোমায় বলতে পারতাম! বাদ দাও, কিছু না।”
“বল না– তুই ঠিক আছিস তো!”
“হ্যাঁ, কোনো সমস্যা নেই। কালকে মনে হয় দেখা করতে পারব না। ওরা থাকবে।”
“ওরা মানে?”
“অমিত আর অণুদ্বীপ।”
“ঠিক আছে। একইসঙ্গে ঘুরব, না হয়।”
“না। হবে না।”
“কেন?”
“সব কেন -এর উত্তর হয় না, তূর্যদা! ছেলেমানুষী করো না। না, মানে না! ব্যস।”
“কী বলছিস? তোর মাথা ঠিক আছে?”
“আমি জানি না। টাটা।”
“শোন… শোন… একটা কথা তো শোন।”
“ হ্যাঁ, বলো। শুনছি।” গলটা বেশ ধরে এসেছে, বোঝা গেল। হয়তো কান্নাসিক্ত। একটু গলা ঝেড়ে তূর্য বলল, “বেশ। তোর সব কথাই এতদিন রেখেছি। তুই ওদের সঙ্গে ঘুরে আমার জন্যে না হয় একদম শেষের দিকে কিছুটা সময় রাখিস। ঘুরতে হবে না। বসে কথা বলব।”
“আচ্ছা, দেখছি।” ফোনটা কেটে দেয়। আর ফোন করেনি, চন্দ্রাণী। তূর্যের কষ্ট হলেও সেও ফোন করেনি। অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু কোনোরূপ জ্বালাতন করেনি। যেন চন্দ্রাণীর কোনো অসুবিধা না হয়!
৩
আনন্দবাজারের সন্ধ্যা। মেলা জমে উঠেছে। রাতের পূর্ণ চাঁদের মায়ায়। মহাধুমধাম। আলোময়। লোকারণ্য। সবাই হেসে লুটোপুটি। একদম পাশে সিংসদনের পিছনের চাতালে বসেছে দুটিতে, চন্দ্রাণী ও তূর্য। তূর্য নীল পাঞ্জাবি ও পাজামা পরে এসেছে। সাদা-কালো ছাপ দেওয়া শাড়ি, কপালে ছোট্ট টিপ, সাদা ব্লাউজ, হাতে একটি সুন্দর বালা পরেছে, চন্দ্রাণী। মেক আপ করলেও এখন আর অবশিষ্ট নেই। আজ একটু দূরেই। কারও মুখে কোনো কথা নেই। অপলক দৃষ্টিতে দেখছে আলোর দিকে। একসময় নিঃশব্দের বেড়াজাল ভেঙে তূর্যই বলে, “কী হয়েছে রে, তোর?” চন্দ্রাণী মুখে কোনো কথা বলে না। অঝোর নয়নে শুধুই কেঁদে ওঠে। তূর্য বলে, “দেখ, কথা না বললে আমি কেমন করে বুঝব, বল। আমি তো আর অন্তর্যামী নয়।”
“কেন হলে না! তুমি কেন এত ভালো হলে গো।” বলেই তূর্যের পাঞ্জাবিটা চেপে ধরে। হাতটা সরিয়ে তূর্য বলে, “বলবি? কেন এমন করছিস? আমার ভালো লাগছে না!”
“কী যে বলি! কেমন করে বলি!”
“আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। প্লীজ, বল!”
“বাবা, আমাদের কল ডিউরেশন দেখেছে।”
“মানে? কাকু কী করে দেখল? তুই তো এখন বাড়ি যাসনি!”
“আমার ফোন ট্রাক হয়। তুমি হয়তো জানো না, তোমার জানার কথাও নয়।”
“তারপরে?”
“বাবাকে আমি সবটা বলেছি। সব– সবটা।”
“ভালো তো! তাতে সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা বাবার নয়।”
“তাহলে? অমিতের?”
“অমিত আমার ছোটো পিসির জায়ের ছেলে। ওর কেন সমস্যা হবে?”
“মানে? তুই যে কালকে বললি, নিজের পিসির ছেলে। তোকে নাকি এমনি “তুমি, তুমি” করেই কথা বলে! ছোটো থেকেই তোরা বন্ধুর মতো মানুষ হয়েছিস!” মুখটা সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
“ হ্যাঁ তো! বন্ধুই তো! ও আমাকে সব কথা বলে! আর ওর মা আমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে।”
“ তুই প্লীজ, আমাকে সত্যি করে সবটা বল তো! একটা স্বচ্ছতা অন্তত থাকুক!”
“সত্যিই বললাম। বিশ্বাস করো।”
“তোকে আমি কোনোদিনই অবিশ্বাস করিনি। অবিশ্বাস করলে এত তাড়াতাড়ি এত জায়গায় নিয়ে যেতাম না, এত আমার কাছের মানুষের সঙ্গে পরিচয়ও করাতাম না।”
“তোমার কোনো ভুল নেই। সব আমার দোষ। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমায় আমি ভালবেসে ফেলেছি। এদিকেও…আমি জানি না… কিচ্ছু জানি না! এখন আমার কী করা উচিত?”
“তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
“আমি জানি না। আমাকে পারলে তুমি ক্ষমা করে দিও… প্লীজ, আমার সঙ্গে কথাটা অন্তত বলো! বলতে বলতেই কেঁদে ওঠে চন্দ্রাণী। তূর্যের তাকে বুকের কাছে টেনে নিতে খুব ইচ্ছা করছিল। কিন্তু না। চেয়েও পারল না। বলল, “তুই আমাকে বললি… কিন্তু সবটা নয়। এইসব গল্পের পিছনে আরও অনেক গল্প লুকিয়ে আছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি আর জানতে চাই না।” চন্দ্রাণী নাক টেনে, চোখ মুছে উত্তর দেয়, “আর কিছু নেই। তুমি ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো আর আমার মাফ করে দিও। ” তূর্য উদাস অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলল, “জানিস! মিথ্যে বলার একটা দুঃখ নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। যাইহোক, ভালো থাকিস। আর আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস না। তাহলে তোর কষ্ট আরও বাড়বে।”
“না, এমন আমি চাই না…” তূর্য মুখটা নিচু করে ধীরে জবাব দেয়, “সব তো আর তোর মনের মতো হতে পারে না, হবেও না।” এমন সময় নিকিতা ডাক দিল, “চন্দু, চল, বাড়ি যাব।” দূর থেকেই চন্দ্রাণী বলল, “তুই চল, আমি আসছি।”
“না, এক্ষুণি আয়। অমিতদারা দাঁড়িয়ে আছে, তোর জন্যে।”
“আসছি” বলেই চন্দ্রাণী পা বাড়ায় তাদের স্টলের দিকে। ঠিক যেন তীরবিদ্ধ পাখির ঝাপটানির মতো তার চলে যাওয়া। এত আলোর মধ্যেও অমাবস্যার অন্ধকার এসে দাঁড়াল। তূর্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে… যেখানে খাবার বিক্রি হয়ে যাবার আনন্দে ছেলেমেয়েরা কাশফুলের ডালগুলো ছিঁড়ে শূন্যে উড়িয়ে দিচ্ছে আলোয়, সেদিকেই। অনেকক্ষণ বসে থাকে তূর্য। আজ পূর্ণিমা। আকাশে চাঁদের আলো দেখা দিচ্ছে। গোপন কথাটির মতো মৃদু অথচ তন্দ্রাচ্ছন্ন আলো। আলোয় ভিজে যাচ্ছে তূর্যের গোটা শরীর। কেমন যেন একটা নেশার মত লাগছে। এই চমকিয়া ঘোর কাটছে না। গ্রহণ-বর্জনের খেলা সাঙ্গ হয়েও যেন হচ্ছে না। চন্দ্রগ্রহণের পরে যে চাঁদটি আকাশে ওঠার কথা ছিল, সেটি আর ওঠে না। দূরে রাস্তার আলো তাকে ব্যঙ্গ করে রাহুর মতো। আর রাঙা আলোয় কর্মীমণ্ডলীর ঘোষণা হয়, “আমরা এবার লাইট অফ করব। এবছরের মতো এখানেই শেষ আমাদের আনন্দবাজার।”
0 Comments