কে গো তুমি, কার হাসিকান্নার ধন
আবীর মুখোপাধ্যায়
শিউলিদল ছড়ানো কাননতলে। বনদেবীর দ্বারে শঙ্খধ্বনি। দূর গগনে উড়ে যায় ডানা মেলা মেঘ। মেঘ, তুমি কোথা যাও? মেঘ উত্তর করে না। কেয়াপাতার নৌকো ভেসে চলে শরৎ-আলোর সরোবরে। নৌকো— বলে যাও? নিরুত্তর স্বপনের দেশে অথিরপরান, ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়া। অধীর আকাশ, এই পাগল হাওয়া, কী গান-গাওয়া! জানে না, রাখাল ছেলে। সে ধেনু নিয়ে চলে। নদীর চরে চখা-চখীর মেলায় হারিয়ে গেছে তার মাঠের বাঁশি! অলীক হাওয়া লাগা কাশবনে সে কেবল ভাবে, ভেবেই চলে, মেলার ভিড়ে চকিতে দেখা মেয়েটির কথা! আর তার মনে পড়ে মাটির দাওয়ায় বসে, দুখিনি মায়ের গাওয়া রবিঠাকুরের একটা গান : ‘‘ওগো কাণ্ডারী, কে গো তুমি, কার হাসিকান্নার ধন/ ভেবে মরে মোর মন—/ কোন্ সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র, কী মন্ত্র হবে গাওয়া।’’
শারদ পত্রিকা কেনার জন্য এখানে ক্লিক করুন শারদীয় এখন শান্তিনিকেতন
শরৎ এলে, উদাস মন কেবলই আমাদের নিয়ে চলে কবেকার বাল্যের পুজোতলায়। ফি বছর সেই কারণে, স্মৃতির শামিয়ানা সরিয়ে ফিরে ফিরে লিখি শরৎ-স্মৃতি। যেন স্মৃতির আলপথে এলোঝড়! তখন ঢাকে-কাঠি মানে, মনে মনে ছুট। ভয় হত ভয়— এই বুঝি পুজো ফুরিয়ে গেল! তারপর? নখ উড়িয়ে, এক ঢোল, এক কাঁসি ; একটি নতুন জামাতেই এক পুজোতলা থেকে আরেক পুজোতলা ; চারদিনের আনন্দ সফর— সত্যিই কি আমরা স্বপ্নের সেই পুজোতলায় ফিরব আর কখনও? জানি না, স্মৃতির চির মুগ্ধতায় দূর নিখিলে চেয়ে থাকি! শিউলিতলার সেই পেট কোঁচড়ে ফুল কুড়ানো মেয়েটিকে এখনও রাখালের মতো স্বপ্নে জিজ্ঞেস করি, ‘কে গো তুমি, কার হাসি কান্নার ধন?’
ভোরের হাওয়ায় সেই বিভাস-রামকেলিতে কিশলয় ঠাকুরের টহলগান, মস্ত-কালো আকাশের নীচে দীপালি গাঁ-ঘরে মা-মাসিদের খই-সিঁড়ি-নারকেল নাড়ু, মুড়ি-মুড়কির ভিয়েন, দুপুর দুপুর মুখুজ্জ্যেবাড়ির শরিকি ঠাকুরদালানে পদ্মপাতায় পাত পেড়ে মোটা-চালের ভাত, বিউলির ডাল, কুমড়োর ঘ্যাঁট, পুকুরের রুই-কাতলার টক— কোথায় গেল... কোথায় যে হারালো সেই সব শারদীয় দিন? কেউ আর এখন হেমন্ত-সন্ধ্যা-আরতি-মানবেন্দ্র-ধনঞ্জয়-পান্নালাল-সতীনাথ-উৎপলা-শ্যামল কিনে মহল্লায় সুরের মায়ানদী ডাকে না। শুধু দিন যায়— এলোমেলো— ভাবি, হয়তো বা নির্দয় স্মৃতির শাপ-শাপান্ত!
কলরব চারিদিকে মহা কলরব।
স্বর্গের নীচে বিশৃঙ্খলা!
সে মড়ক ছিল, নাকি ইঙ্গিত?
নাকি শেষের শুরু। টিউব থেকে রিলস, নিরন্তর স্ক্রোল। বিনিদ্র পড়শির উসখুস বিপণন। সবজান্তা সব্বাই। সকলে শিল্পী-কবি-লেখক। রাষ্ট্রনায়কের কান ছোঁয়া এখন সহজ! মর্জি-মাফিক চণ্ডীমণ্ডপ। বড্ড বাড়! দে ঠুঁকে দে— দু পারদ! শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম? দমকা হাওয়ায় ভোট বালাই। দুয়ারে বোধহীন, বেয়াদব বিজ্ঞাপন। শকুন কাগজওয়ালা, কত আর? আঙুল-স্পর্শ জেগে ওঠে চতুর হাতছানি। মুছে যায় বাংলা আমার বাংলা। মায়ের ভাষা। মাতৃভাষা। লেপ্টে হা-হা রব!
রাখাল, তুমি কি জানো?
মেলার ভিড়ে হারানো সেই মেয়েটি এখন কোথায় থাকে? জল রঙে আঁকা শেফালিবনে, নদী কিনারে, সরোবরে— কোথাও যে দেখি না তাকে!
বুঝি এই আছে, এই সে নেই!
‘লুকায়ে আপন মায়াতে’, অভিমানিনী!
যেন বা সে রবিঠাকুরের কালাংড়া-ভৈরবীতে গাঁথা গানের আখড়—
‘‘সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো।
দূর কুসুমের গন্ধ এনে খোঁজায় মধু সেই তো॥
সেই তো তোমার পথের বঁধু সেই তো।
এই আলো তার এই তো আঁধার, এই আছে এই নেই তো॥’’
0 Comments